আবেদন করা মানেই এই নয় যে, সেই পণ্যগুলো জিআই সনদ পাবেই
জিআই সনদের অপেক্ষায় ভোলার মহিষের কাঁচা দুধ/বিবিসি
এ বছরের ১ ফেব্রুয়ারি ভারত সরকারের সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ফেসবুক পেজে একটি পোস্টে টাঙ্গাইল শাড়িকে পশ্চিমবঙ্গের ঐতিহ্য উল্লেখ করা হয়। এতে বলা হয়, এটি এই অঞ্চলের সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের বহিঃপ্রকাশ।
যদিও “টাঙ্গাইল শাড়ি” বাংলাদেশে বহুল পরিচিত একটি বিষয়। টাঙ্গাইলের তাঁতশিল্প বাংলাদেশের প্রাচীনতম কুটির শিল্পের একটি। টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ি বিশ্বব্যাপী সমাদৃত। তাই ভারতের এমন দাবির পরিপ্রেক্ষিতে বিষয়টি নিয়ে বেশ আলোচনা শুরু হয়েছে। সেই সঙ্গে আলোচনায় রয়েছে আরেকটি বিষয়। সেটি হলো- জিআই।
মূলত কোনো একটি দেশের নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের মাটি, পানি, আবহাওয়া ও সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে উচ্চতা এবং সেখানকার জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতি যদি কোনো একটি পণ্য উৎপাদনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, তাহলে সেটিকে সেই দেশের ভৌগোলিক নির্দেশক (জিওগ্রাফিক্যাল ইন্ডিকেশন- জিআই) পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
নিয়ম অনুযায়ী, কৃষিপণ্য, প্রকৃতি থেকে আহরিত সম্পদ ও কুটির শিল্পকে এই সনদ দেওয়া হয়। যেসব পণ্য এই স্বীকৃতি পায়, সেগুলোর মাঝে ভৌগোলিক গুণ, মান ও স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য থাকে।
কোনো পণ্য যখন জিআই স্বীকৃতি পায়, তখন সেটিকে বিশ্বব্যাপী ব্র্যান্ডিং করা সহজ হয়। তখন দেশে বিদেশে ঐ পণ্যগুলোর আলাদা কদর থাকে। শুধু তাই নয়, সনদ প্রাপ্তির পর ওই অঞ্চল বাণিজ্যিকভাবে পণ্যটি একাধারে উৎপাদন করার অধিকার এবং আইনি সুরক্ষা পায়। অন্য কোনো দেশ বা অন্য কেউ তখন আর এই পণ্যের মালিকানা বা স্বত্ব দাবি করতে পারে না।
গত কয়েক বছরে বাংলাদেশের মোট ২১টি পণ্য জি আই বা ভৌগোলিক নির্দেশক হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। ১৪টি পণ্যের জন্য নতুন করে আবেদন জমা পড়েছে। এছাড়া, আবেদনের প্রক্রিয়ার মাঝে আছে আরও দু’টি পণ্য।
তবে কোনো পণ্যের জন্য আবেদন করার অর্থ এই নয় যে সেগুলো জিআই সনদ পাওয়ার যোগ্য বা পাবেই। নানারকম পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর নির্ধারিত হয় যে কোন পণ্য এই তালিকায় স্থান পাবে।
যাচাই-বাছাইয়ের পর এগুলোর কোনোটি যদি জি-আই সনদ পেয়ে যায়, তাহলে সেগুলো সেই দেশের নিজস্ব পণ্য হিসেবে বিশ্ব দরবারে পরিচিতি লাভ করবে।
জি-আই সনদ পাওয়ার আশায় বাংলাদেশের যেসব পণ্য
আন্তর্জাতিক মেধাস্বত্ব বিষয়ক সংস্থা “ওয়ার্ল্ড ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি রাইটস অর্গানাইজেশন”র (ডব্লিউআইপিও) নিয়ম মেনে বাংলাদেশের শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীনে পেটেন্টস, ডিজাইন এবং ট্রেডমার্ক বিভাগ (ডিপিডিটি) জি আই স্বীকৃতি ও সনদ দিয়ে থাকে।
ডিপিডিটি থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, যে ১৪টি পণ্যের জন্য আবেদন জমা পড়েছে, সেগুলো হলো-
যশোরের খেজুর গুড়
- নরসিংদীর লটকন
- নরসিংদীর অমৃতসাগর কলা
- জামালপুরের নকশীকাঁথা
- মধুপুরের আনারস
- সুন্দরবনের মধু
- মৌলভীবাজারের আগর-আতর
- রংপুরের হাড়িভাঙ্গা আম
- মুক্তাগাছার মণ্ডা
- রাজশাহীর মিষ্টিপান
- শেরপুরের ছানার পায়েশ
- ভোলার মহিষের কাঁচা দুধ
- গোপালগঞ্জের রসগোল্লা
- নওগাঁ’র নাগ ফজলি আম
এছাড়া, আবেদনের প্রক্রিয়ার মাঝে আছে আরও দু’টি পণ্য। সেগুলো হলো-
- দিনাজপুরের লিচু
- টাঙ্গাইলের শাড়ি
জিআই সনদের আবেদন প্রক্রিয়া
বাংলাদেশে সর্বপ্রথম ২০১৩ সালে ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য (নিবন্ধন ও সুরক্ষা) আইন হয়। এরপর ২০১৫ সালে আইনের বিধিমালা তৈরির পর জি আই পণ্যের নিবন্ধন নিতে আহ্বান জানায় ডিপিডিটি।
আইন অনুযায়ী, ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্যের নিবন্ধনের জন্য কোনও ব্যক্তিসংঘ, প্রতিষ্ঠান বা সংগঠনকে ডিপিডিটিতে পর্যাপ্ত প্রমাণ ও তথ্য-উপাত্তসহ আবেদন করতে হয়। আবেদনপত্র জমা দেওয়ার পর সেগুলোকে নানাভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়। কোনো ভুলভ্রান্তি থাকলে আবেদনকারীকে পরিবর্তন বা সংশোধনের প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেওয়া হয়।
আবেদনপত্রের সাথে যেসব তথ্য দেওয়া হয়েছে, সেগুলো বিবেচনা করার পর সব ঠিক থাকলে সেই জার্নালে প্রকাশ করা হয়। জার্নালে প্রকাশিত হওয়ার পর কেউ যদি সেই পণ্যের বিরোধিতা করতে চায়, তাহলে তার জন্য সর্বোচ্চ দুই মাস সময় ধরা আছে। সর্বশেষ ধাপ হলো জি আই সনদ বা নিবন্ধন সার্টিফিকেট প্রাপ্তি।
বাংলাদেশের যেসব পণ্য জিআই সনদ পেয়েছে
জি আই আইন বিধিমালা পূরণ করে এখনও পর্যন্ত মোট ২১টি পণ্য জি আই সনদ পেয়েছে। সেগুলো হলো :
- জামদানি শাড়ি
- বাংলাদেশের ইলিশ
- চাঁপাইনবাবগঞ্জের খিরসাপাত আম
- বিজয়পুরের সাদামাটি
- দিনাজপুরের কাটারিভোগ
- বাংলাদেশের কালোজিরা
- রংপুরের শতরঞ্জি
- রাজশাহীর সিল্ক
- ঢাকার মসলিন
- বাংলাদেশের বাগদা চিংড়ি
- রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের ফজলি আম
- বাংলাদেশের শীতলপাটি
- বগুড়ার দই
- শেরপুরের তুলসীমালা
- চাপাইনবাবগঞ্জের ল্যাংড়া আম
- চাপাইনবাবগঞ্জের আশ্বিনা আম
- বাংলাদেশের ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল
- নাটোরের কাঁচাগোল্লা
- টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ির চমচম
- কুমিল্লার রসমালাই
- কুষ্টিয়ার তিলের খাজা
যদিও ডিপিডিটি’র ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্যের জার্নালে ১৭টি পণ্যের কথা উল্লেখ রয়েছে। তবে বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত জিআই সনদপ্রাপ্ত পণ্যের সংখ্যা যে ২১টি, সেটি সাংবাদিকদের নিশ্চিত করেছেন ডিপিডিটি মহাপরিচালক মো. মুনিম হাসান।
সূত্র: বিবিসি বাংলা অবলম্বনে