২২ বছর পর মরা খালগুলোতে ফিরেছে প্রাণ, দূর হবে জলাবদ্ধতা

বরিশাল নগরীর ভেতর দিয়ে প্রবাহিত খালগুলোতে নানা ধরনের বর্জ্য-আবর্জনা জমে নালায় রূপ নিয়েছিল। বলতে গেলে দখল-দূষণে মরে গিয়েছিল। কিছু এলাকায় আবর্জনা এমনভাবে জমে ছিল যে, সেখানে খাল আছে কিনা, সেটিও বোঝার উপায় ছিল না। সেসব খালে ২২ বছর পর ফিরছে প্রাণ, দেখা যাচ্ছে পানিপ্রবাহ। এই পানিপ্রবাহ স্বাভাবিক থাকলে আগামী বর্ষা মৌসুমে জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তি পাবে নগরবাসী।

পানি উন্নয়ন বোর্ড জানায়, নগরীর পলাশপুর, আমানতগঞ্জ, সাগরদী, রূপাতলী, চাঁদমারি, লাকুটিয়া ও জেল খালের ১৯ কিলোমিটার খনন করে পানিপ্রবাহ ফিরিয়ে আনার কাজ চলছে। চলতি বছরের শুরুতে কাজ শুরু হয়েছে। সাতটি খালের খননকাজের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ছয় কোটি সাত লাখ টাকা। ইতোমধ্যে তিনটি খালে দেখা যাচ্ছে পানিপ্রবাহ।বরিশাল সিটি করপোরেশন সূত্রে জানা গেছে, সিটি করপোরেশন ঘোষণার ২২ বছর পর প্রথমবার নগরীর প্রাণকেন্দ্রের সাতটি খালের খননকাজ শুরু হয়েছে। এতে মরা খালগুলোতে প্রাণ ফিরতে শুরু করেছে। কীর্তনখোলা নদীর পানি খালগুলোতে আসা-যাওয়া করছে। অথচ বছরের পর বছর পানিপ্রবাহ বন্ধ থাকায় খালগুলোতে ময়লা-আবর্জনা জমাট বেঁধে পোকামাকড় বাসা বেঁধে ছিল। পানি চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় একটু বৃষ্টিতেই ডুবে যেতো নগরী। দুর্ভোগে পড়তো মানুষ। বিশেষ করে খালপাড়ের বাসিন্দারা বেশি দুর্ভোগে ছিলেন। এবার পোকামাকড় এবং মশার উপদ্রব থেকে মুক্তি মিলেছে তাদের। জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তি পাবে নগরীর সাড়ে পাঁচ লাখ বাসিন্দা।নগরীর বাসিন্দারা জানিয়েছেন, খননের পর লাকুটিয়া, সাগরদী ও পলাশপুর খালে পানিপ্রবাহ শুরু হয়েছে। এসব খালে কীর্তনখোলা নদীর পানি ঢেউ খেলছে। অথচ কয়েকদিন আগেও এসব খাল ময়লার ভাগাড় ছিল। অল্প সময়ে খালগুলো পরিষ্কার হয়ে যাওয়ায় দারুণ খুশি নগরবাসী। খালে পানিপ্রবাহ ধরে রাখতে ময়লা-আবর্জনা না ফেলার কথা জানিয়েছেন তারা। একইসঙ্গে প্রতি বছর খাল সংস্কারের দাবি তুলেছেন।

স্বস্তির কথা জানিয়ে লাকুটিয়া খালপাড়ের বাসিন্দা মো. শফিকুর রহমান বলেন, ‘খালটি বাবুগঞ্জ উপজেলাকে নগরীর সঙ্গে যুক্ত করেছে। একসময় নৌকা-ট্রলার চলতো। কৃষক এবং ব্যবসায়ীরা বাবুগঞ্জ থেকে মালামাল নিয়ে নগরীতে আসতো। কিন্তু নগরায়ণের পর বাসাবাড়ির অত্যাচারে খালটি অস্তিত্ব হারায়। দখল-দূষণে ভরাট হয়ে গিয়েছিল। ফলে একটু বৃষ্টিতে আপশপাশের এলাকায় জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হতো। এতে দুর্ভোগ নিয়ে চলাচল করা লাগতো। এবার খননের কারণে বর্ষা মৌসুমে জলাবদ্ধতায় পড়তে হবে না আমাদের।’

সিটি করপোরেশন ঘোষণার পর থেকে বিভিন্ন সময় খাল সংস্কারের আবেদন করলেও কোনও কাজ হয়নি বলে জানালেন সাগরদী খালপাড়ের বাসিন্দা মো. মনির হোসেন। তিনি বলেন, ‘২০-২২ বছর পর খাল খননে পানিপ্রবাহ নিশ্চিত হয়েছে। বিশেষ করে মশার উপদ্রব থেকে রক্ষা পেয়েছে মানুষজন। আগামী বর্ষা মৌসুমে জলাবদ্ধতা থেকে রক্ষা মিলবে। এখন প্রয়োজন খালগুলো যেখানে কীর্তনখোলা নদীর সঙ্গে মিলিত হয়েছে, অর্থাৎ মোহনার জায়গা সার্বক্ষণিক পরিষ্কার রাখা। সেইসঙ্গে প্রতি বছর সংস্কার চলমান রাখা। পাশাপাশি দুই পাড়ের বাসাবাড়ির লোকজন খালে ময়লা-আবর্জনা ফেললে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া।’

খালগুলোর খননকাজ ভালো উদ্যোগ বলে জানিয়েছেন নগর উন্নয়ন ফোরামের সমন্বয়ক কাজী এনায়েত হোসেন শিবলু। তিনি বলেন, ‘খাল সংস্কারের সঙ্গে সঙ্গে দুই পাড়ের জমিও উদ্ধার করতে হবে। তা না হলে দুই পাড়ের দখলদাররা আবারও খাল দখল করবে। এতে সংস্কার ভেস্তে যাবে। এজন্য এস এ পর্চা অনুযায়ী, ম্যাপ নিয়ে দুই পাড়ের জমিতে পিলার দেওয়ার দাবি জানাই। এতে খালপাড় দখলদারমুক্ত রাখা সম্ভব হবে। এছাড়া দুই পাড়ের সৌন্দর্যবর্ধন করা হলে তাতে খালের জমি রক্ষা করা সম্ভব হবে।’

এদিকে, যেসব খালে প্রাণ ফিরেছে সেগুলোর পাড়ের সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ শুরু হয়েছে। কয়েকদিন আগে সাগরদীর দুই পাড়ের সৌন্দর্যবর্ধন কাজের উদ্বোধন করেন সিটি মেয়র আবুল খায়ের আব্দুল্লাহ খোকন সেরনিয়াবাত। তিনি বলেন, ‘খাল সংস্কারের কাজ চালাচ্ছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। কাজ শেষ হওয়ার পর প্রতিটি খালের দুই পাড়ের সৌন্দর্যবর্ধন করা হবে। নগরবাসী খালপাড়ের সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারবে। বয়স্ক ও শিশুরা সুন্দর পরিবেশ পাবে। যেখানে ব্যায়াম থেকে শুরু করে নির্মল অক্সিজেন পাওয়া যাবে।’

সিটি মেয়র আরও বলেন, ‘সাগরদী খালের দুই পাড়ে চার কোটি ২৫ লাখ টাকা ব্যয়ে ১২৪০ মিটার ওয়াকওয়ে ও সাইকেলওয়ে, ৮৬টি কংক্রিটের বেঞ্চ, ১৫০টি ডাস্টবিন, ৬৮টি ফ্লাডলাইট, চারটি অ্যাপ্রোচ র‌্যাম্প নির্মাণ করা হবে। একইভাবে প্রতিটি খালের দুই পাড় দৃষ্টিনন্দন করে গড়ে তোলা হবে।’

আগামী ফেব্রুয়ারির মধ্যে সাতটি খালের খননকাজ শেষ হবে বলে জানিয়েছেন বরিশাল পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী খালিদ বিন ওলিদ। তিনি বলেন, ‘ইতোমধ্যে যেসব খালের খনন শেষ হয়েছে, সেখানে কীর্তনখোলা নদীর পানি প্রবেশ করেছে। এর সুফল পাবে নগরবাসী। সবগুলো খালের খননকাজ শেষ হলে নগরীর দীর্ঘদিনের সমস্যা জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তি পাবে সাড়ে পাঁচ লাখ বাসিন্দা।’

পানিপ্রবাহের পর এসব খাল রক্ষার দায়িত্ব নগরবাসীর উল্লেখ করে খালিদ বিন ওলিদ বলেন, ‘খালে কোনও ধরনের ময়লা-আবর্জনা না ফেলার এবং দুই পাড় দখল না করার অনুরোধ করছি আমরা। যারা খালে ময়লা-আবর্জনা ফেলবে এবং দখল করবে তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে পারে সিটি করপোরেশন। পর্যায়ক্রমে নগরীর আশপাশে থাকা ছোট-বড় ৫৬টি খাল সংস্কারের আওতায় আসবে। সেভাবে কাজ চলছে।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *