নির্বাচন কমিশন বারবার সতর্ক করে বলছে, কোনও ধরনের গুজবে কান দেওয়া যাবে না
কাওরান বাজারে রাস্তার পাশের চায়ের দোকান। সকাল ৭টা। খুচরা ব্যবসায়ীরা হাতের কাজ সেরে এক কাপ চা নিয়ে বসে এলাকায় ভোট দিতে যাবেন কবে, তা নিয়ে আলাপ করছেন। পাশে এক অফিসের কর্মকর্তা বেশ ‘বিশেষজ্ঞ’ মত দিয়ে বলছেন— আরে দেখেন না, ভোট মনে হয় হবে না। ব্যবসায়ীরা একজন আরেকজনের মুখ চাওয়াচাওয়ী করে তার কথার সূত্র জানতে চাইলে ওই কর্মকর্তা বলেন, গোয়েন্দা সংস্থায় আমার বন্ধু আছে, তারা বলেছে।
সেদিনই লালমাটিয়ার রাস্তায় এক প্রার্থীর নির্বাচনি মিছিল চলে যাওয়ার পর ভ্যান-রিকশায় ফল বিক্রেতার স্বগতোক্তি ‘পিটার হাস নির্বাচন থামাতে ইন্ডিয়া গেছে, আসলে মিছিল বাইর কইরেন। নির্বাচন হয় কিনা ঠিক আছে?’ কে বলেছে নির্বাচন হবে না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘রোজ বিএনপির নেতারা রাস্তায় কাগজ দেয় (লিফলেট) আর এসব বলে।’ভোট নাও হতে পারে’, ‘সাত তারিখের আগে কিছু একটা হবে’, ‘পিটার হাস ভারত থেকে ফিরে ভোট বন্ধ করে দেবে’— এরকম নানা গুজবে ভরে গেছে নির্বাচনি মাঠ। কেউ বলার চেষ্টা করছে ‘ভোট দিতে দেওয়া হবে না’। এদিকে নির্বাচন কমিশন বারবার সতর্ক করে বলছে, কোনও ধরনের গুজবে কান দেওয়া যাবে না।
গত ছয় মাস ধরে একের পর এক গুজব ছড়াতে দেখা গেছে। নির্বাচন প্রক্রিয়া শুরুর পর সেটা বেশি ত্বরান্বিত হয়েছে বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। সর্বশেষ আসনভিত্তিক গুজবও দেখা দিয়েছে। আসন্ন দ্বাদশ জতীয় সংসদ নির্বাচনে ফরিদপুর-৪ (ভাঙ্গা, সদরপুর-চরভদ্রাসন) আসনের আ.লীগ মনোনীত প্রার্থী ও দলের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির কো-চেয়ারম্যান কাজী জাফরউল্যাহর বিরুদ্ধে ভোট থেকে সরে দাঁড়ানোর গুজব ছড়িয়ে দেওয়া হয় মাঠে। তবে তিনি ভোটারদের উদ্দেশে বলেছেন, ‘কোনও গুজব বা প্রপাগান্ডায় কান দেবেন না। আমি কয়েক দিন অসুস্থ ছিলাম। তাই নির্বাচনি মাঠে নামতে পারিনি। আর এ সুবাদে আমি নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছি বলে প্রতিপক্ষ স্বতন্ত্র প্রার্থীর কর্মীরা এলাকায় গুজব ছড়িয়ে দিয়েছে। এতে সাধারণ ভোটাররা বিভ্রান্তিতে পড়ে গিয়েছিল।’
এদিকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল মঙ্গলবার (২৬ ডিসেম্বর) চট্টগ্রাম মহানগরীর পিটিআই মিলনায়তনে আইনশৃংখলা বাহিনী ও মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে মতবিনিময় শেষে ভোটারদের গুজবে কান না দিয়ে কেন্দ্রে গিয়ে ভোটাধিকার প্রয়োগের আহ্বান জানান। এসময় নির্বাচনি ফলাফল নিয়ে মানুষের মধ্যে কোনও ধরনের শঙ্কা থাকার কোনও কারণ নেই বলেও উল্লেখ করেন সিইসি। নির্বাচনকে সুষ্ঠু ও ভোটারদের জন্য নিরাপদ পরিবেশ তৈরি করতে আইনশৃংখলা বাহিনী ও মাঠ প্রশাসনকে নির্দেশ দেন তিনি।
গত নভেম্বরে কোনও ধরনের গুজব এবং উসকানিমূলক বক্তব্যে জনসাধারণকে কান না দেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছে তথ্য অধিদফতর। অধিদফতরের প্রকাশিত তথ্য বিবরণীতে এমন অনুরোধ জানানো হয়েছে। সেই সঙ্গে তথ্য বিবরণীতে আরও বলা হয়, ‘গুজব সৃষ্টিকারীর সম্পর্কে কোনও ধরনের খবর পেলে অবিলম্বে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে জানানোর জন্যও পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।’
গত তিন-চার মাসে নির্বাচনকেন্দ্রিক গুজব বেড়ে গেছে বলে উল্লেখ করেন ‘রিউমার স্ক্যানার’ এর কর্ণধার সাজ্জাদ হোসেন। রিউমার স্ক্যানার একটি স্বাধীন সাংবাদিকতার উদ্যোগ, যার প্রধান লক্ষ্য দেশের চলমান গুজব ও ভুয়া খবর নির্মূল করা এবং সঠিক তথ্য উদঘাটন। তিনি বলেন, ‘নির্বাচন ও সেনাবাহিনী নিয়ে এবারের নির্বাচন প্রস্তুতির সময়ে গুজব বেশি হচ্ছে বলে আমাদের প্রাথমিক পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে।’
প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী ও আওয়ামী লীগের দফতর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়া বলেন, ‘সাংবিধানিক প্রক্রিয়া মেনে নির্বাচন হচ্ছে। এ নিয়ে কেউ গুজব ছড়ালে সেটা ভয়াবহ অপরাধ। নির্বাচন নিয়ে অপপ্রচার রাষ্ট্রদোহিতার শামিল। এদের চিহ্নিত করে বিচার করা জরুরি।’ তিনি বলেন, ‘নির্বাচন হবে ৭ জানুয়ারি। আমরা ব্যালটের মাধ্যমে এর জবাব দেবো।’
‘নির্বাচন হচ্ছে এবং হবে— এটা এখন দিবালোকের মতো স্পষ্ট’, উল্লেখ করে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান বলেন, ‘এই নির্বাচনকে বিরোধী পক্ষ নানাভাবে বিতর্কিত করার চেষ্টা চালাচ্ছে। তারা যেকোনও মূল্যে জনগণকে ভোটদান থেকে বিরত রাখতে চায়। এটা তারা অনেকটা জানিয়ে-শুনিয়ে করছে। তবে আমার মনে হয় না— এগুলো খুব বেশি প্রভাব পড়বে নির্বাচনের ওপর