মুক্তিযুদ্ধে সৈয়দপুর 

পরিবারের ১০ সদস্যকে হারিয়েও মেলেনি ‘শহীদ পরিবার’র স্বীকৃতি

নীলফামারী:  মহান মুক্তিযুদ্ধে দাদা-দাদী ও বাবা-মাসহ পরিবারের ১০ জনকে হারিয়েছেন মো. আব্দুর রশিদ। কাউকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে, কাউকে সেপটিক ট্যাংকে ফেলে আর বড় বোনকে নৃশংসভাবে হত্যা করার দৃশ্য আজও ভুলতে পারেননি তিনি।

স্বাধীনতার ৫২ বছরেও পরিবারটি পায়নি শহীদের স্বীকৃতি, মেলেনি কোনও পুনর্বাসন। সেই স্বীকৃতি ও পুনর্বাসনের জন্য মন্ত্রণালয় ও সমাজপতিদের দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন তিনি।মো. আব্দুর রশিদ জানান, বাবার ছিল রুটি-বিস্কুটের কারখানা। থাকতেন নীলফামারীর সৈয়দপুর শহরের বাঁশবাড়ি শহীদ মাহতাব বেগ লেনে।১৫ এপ্রিল আচমকা রাজাকাররা বাড়িতে প্রবেশ করেন। আমার দাদীকে প্রথমে চড় মেরে ৩ জন রাজাকার আমার দাদা শহীদ আব্দুল ওয়াদুদের উপর চড়াও হয়।দাদার পেটে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করা হয়। গোসল ও কাফন ছাড়াই দাদাকে বাড়ির পাশে গর্তে মাটি চাপা দিয়ে চলে যায় রাজাকাররা। এর কয়েকদিন পর সেই লাশ তুলে দহলায় পুঁতে ফেলা হয়।
 
তিনি জানান, সেসময় পাকিস্তানি সেনারা নিরীহ বাঙালিদের ধরে নিয়ে গিয়ে বিমানবন্দর নির্মাণ কাজে লাগান। আমার বাবা শহীদ মোহাম্মদ সহিদ ও বড় ভাই আবু সাকের বিমানবন্দরের কাজ শেষে বাড়িতে এসে দেখেন  কান্নার রোল। অসুস্থতার কারণে দাদা কাজে যেতে না পারায় তাঁকে হত্যা করা হয়েছে। পাশের এক অবাঙালি বাবাকে পরামর্শ দেয় আত্মগোপনের। আমি, বাবা ও বড় ভাই লুকিয়ে ছিলাম এক অবাঙালির বাসায়। সেখান থেকে পাক সেনারা ও রাজাকাররা বের করে আনেন। আমার দাদী, মা, ভাই বোনদের হত্যা করে। বড় ভাইকে জীবন্ত অবস্থায় ফেলে দেওয়া হয় পৌরসভার সেপটিক ট্যাংকে। বাবা আমাকে নিয়ে পালাতে গিয়ে বল্লম ছুড়ে হত্যা করে রাজাকাররা। এরপর  অনেকগুলো লাশের মধ্যে ফেলে দেওয়া হয়।এসময় খুলনা থেকে নববিবাহিতা বোন নূরজাহান বাবার বাড়িতে বেড়াতে এসেছিলো। নরপিশাচরা তাকে পাশবিক অত্যাচার চালায়। তার দুটি স্তন কেটে নেয়। আল্লাহর দোহাই দিয়েও রেহাই পাননি বোনটি। তাকে জবাই করে হত্যা করা হয়। ওই বোনের ইশারায় সেদিন পালিয়ে গিয়ে প্রথমে টয়লেটে আশ্রয় নেই। সেখান থেকেও আমাকে মারার জন্য দহলার দিকে নেওয়া হয়। তৌহিদ নামে একজন আমাকে বাঁচিয়ে দেয়। এভাবে তার পরিবারের ১০ জনকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হলেও এখনো শহীদের স্বীকৃতি পাননি, পাননি কোনো পুনর্বাসনের সহযোগিতা। তার ৩ ছেলে ৩ মেয়ের মধ্যে ২০২০ সালের ২৩ আগস্ট মেঝ মেয়ে কিডনি রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। বর্তমানে ছোট ছেলে কিডনি রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়েছেন। টাকার অভাবে চিকিৎসা করাতে পারছেন না। সংসারও ভালোভাবে চলছে না।
 
১৯৭১ সালের ১৫ এপ্রিল সৈয়দপুর শহরে আব্দুর রশিদের পরিবারসহ চারহাজারেরও বেশি মুক্তিকামী বাঙালিদের নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। সৈয়দপুরে ক্যান্টনমেন্ট থাকার কারণে এখানকার বিহারিরা সহযোগিতা পেয়েছে পাকিস্তানি সেনাদের। মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাসে সৈয়দপুরের রেল কারখানা ব্রয়লার শপে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয় স্বাধীনতাকামী মানুষদের। অনেক পরিবার যেমন শহীদের স্বীকৃতি পায়নি। যার ফলে নতুন প্রজন্ম সৈয়দপুরের হত্যাযজ্ঞের প্রকৃত ইতিহাসও জানতে পারছে না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *