কাউন্সিলর আজমলের ‘পরিকল্পনা’, ঢাকা থেকে আনা হয় দুই ওয়েলডিং মিস্ত্রিকে
ওয়ার্ড কাউন্সিলর আজমল ভুঁইয়া
গাজীপুরের শ্রীপুরের বনখারিয়া এলাকায় রেললাইন কেটে উপড়ে ফেলার ঘটনায় ‘মূল পরিকল্পনাকারী’ ছিলেন গাজীপুর সিটির ২৮ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর আজমল ভুঁইয়া। ঘটনার একদিন আগে (১১ ডিসেম্বর) তার বাসায় অনুষ্ঠিত বৈঠকে এই ‘পরিকল্পনা’ করা হয়। বৈঠকে স্থানীয় বিএনপি নেতাকর্মীদের মধ্যে প্রায় ২৭-২৮ জন উপস্থিত ছিলেন। রেললাইন উপড়ে ফেলে বড় ধরনের নাশকতার জন্য দায়িত্ব দেওয়া হয় আজিম উদ্দিন কলেজ শাখা ছাত্রদলের আহ্বায়ক ইবনে সীনা চৌধুরী তোহাকে। তোহা স্থানীয় যুবদল ও ছাত্রদলের কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে পুরো পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেন। এজন্য যুবদলের সাংগঠনিক সম্পাদক মাসুমের মাধ্যমে ঢাকা থেকে দুজন ওয়েলডিং মিস্ত্রিকে ভাড়া করা হয়। ঘটনার দিন ১২ ডিসেম্বর রাতে তারা একটি
ডিসেম্বর রাতে তারা একটি হায়েস গাড়ি নিয়ে গাজীপুরের বিভিন্ন এলাকায় ঘোরাঘুরি করেন। এর আগেই সালনা এলাকার ‘বাঁশবাগান’ রেস্টুরেন্ট থেকে দুটি গ্যাস সিলিন্ডার গাড়িতে তুলে নেওয়া হয়। রাত সাড়ে ১২টার দিকে ঘটনাস্থল থেকে প্রায় ৩-৪ কিলোমিটার দূরে গাড়ি রেখে শ্রীপুরের প্রহল্লাদপুর ইউনিয়নের বনখারিয়া রেলব্রিজের পাশের রেললাইনে যান তারা।
এরপর রাত আনুমানিক ৩টা থেকে ৪টার মধ্যে রেললাইন কাটে দুর্বৃত্তরা। এতে মোহনগঞ্জ-ঢাকা রুটে চলাচলকারী মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস দুর্ঘটনার কবলে পড়ে। দুর্ঘটনায় ট্রেনের সাতটি বগি লাইনচ্যুত হয়ে একজনের মৃত্যু ও ১০ জন গুরুতর আহত হন। এ ঘটনায় বাংলাদেশ রেলওয়ের ঊর্ধ্বতন উপ-সহকারী প্রকৌশলী () আশ্রাফুল আলম খাঁন বাদী হয়ে অজ্ঞাত আসামিদের বিরুদ্ধে ঢাকা রেলওয়ে থানায় একটি মামলা দায়ের করেন।
আলোচিত ওই ঘটনার ছায়াতদন্তে নেমে গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের গোয়েন্দা উত্তর বিভাগের এডিসি শাহাদত হোসেন সুমার নেতৃত্বে গোয়েন্দারা সাত দুর্বৃত্তকে গ্রেফতার করে। গ্রেফতারকৃতরা হলেন—গাজীপুরের ২৮ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর হাসান আজমল ভুঁইয়া, জান্নাতুল ইসলাম, মেহেদী হাসান, জুলকার নাইন আশরাফি ওরফে হৃদয়, শাহানুর আলম, সাইদুল ইসলাম ও সোহেল রানা। গ্রেফতারকৃতরা সবাই স্থানীয় বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠনের বিভিন্ন পর্যায়ের সাবেক ও বর্তমান নেতাকর্মী।
রবিবার (১৭ ডিসেম্বর) এক সংবাদ সম্মেলনে গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার মাহবুবুর রহমান জানান, গোয়েন্দা তথ্য ও তথ্য-প্রযুক্তির মাধ্যমে গোয়েন্দাতথ্য ও তথ্য-প্রযুক্তির মাধ্যমে গোয়েন্দা পুলিশের একটি দল প্রথমে জান্নাতুল ইসলাম ও মেহেদী হাসানকে আটক করে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তারা ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ততার কথা স্বীকার করে। গাজীপুর মহানগর ছাত্রদলের সাংগঠনিক সম্পাদক মাসুম ও আজিমুদ্দিন কলেজ শাখা ছাত্রদলের আহ্বায়ক তোহার নেতৃত্বে ৮ জন মিলে রেললাইন কাটে বলে তথ্য দেয়। পরে অভিযান চালিয়ে আলোচিত এই ঘটনার মূল পরিকল্পনাকারী ও অর্থদাতা কাউন্সিলর আজমল ভুঁইয়া, হৃদয়, শাহানুর, সাইদুল ও সোহেল রানাকে গ্রেফতার করা হয়।প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতারকৃতরা জানান, গত ১১ ডিসেম্বর রাতে কাউ ওরেন্সিলর বিএনপি নেতা আজমল ভুঁইয়ার বাসায় একটি বৈঠক হয়। ওই বৈঠকে দলের উচ্চ পর্যায় থেকে বড় কোনও নাশকতা করার চাপ রয়েছে বলে জানানো হয়। পরে আলোচনার ভিত্তিতে তারা রেললাইন কাটার সিদ্ধান্ত নিয়ে তা বাস্তবায়ন করার জন্য তোহাকে দায়িত্ব দেয়।
যেভাবে রেললাইন কাটা হয়
আলোচিত এ ঘটনায় গ্রেফতারকৃত সাত আসামির মধ্যে তিন জন রবিবার আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। আদালতে দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে শাহানুর জানান, তিনি ছাপাখানার সাপ্লাইয়ের ব্যবসা করেন ও গাজীপুরে বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। আগে স্থানীয় আজিমুদ্দিন কলেজ শাখা ছাত্রদলের সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন।
জবানবন্দিতে শাহানুর জানান, ‘চলমান অবরোধ ও হরতালের কার্যক্রম সফল করার জন্য এবং সরকারের ভাবমূর্তি বিনষ্ট করতে গত ১১ ডিসেম্বর আজমল ভুঁইয়ার বাসায় রেললাইন উপড়ে ফেলে নাশকতার পরিকল্পনা হয়।আমি ওই বৈঠকে খাবার পরিবেশনের দায়িত্বে ছিলাম। ওই মিটিংয়ে প্রায় ২৭-২৮ জন উপস্থিত ছিল। বৈঠকে এই দায়িত্ব দেওয়া হয় তোহাকে। তবে আমি ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলাম না।’
নাশকতার সময় ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকা মেহেদী হাসান আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে বলেন, ‘আমি আজিমুদ্দিন কলেজের সাবেক ছাত্র। সেই সুবাদে ইবনে সীনা চৌধুরী তোহা ভাইয়ের সঙ্গে আমার পরিচয়। তার সঙ্গে মাঝে মধ্যে ছাত্রদলের মিছিল-মিটিংয়ে যেতাম। গত ডিসেম্বর তোহা ভাই আমাকে বলেন, ১২ তারিখ রাতে কাজ আছে, থাইকো। ১২ তারিখ সন্ধ্যার পরপরই আমার বাসায় আসে মঈন ও রাব্বী, তারপর আমরা তিন জন মিলে বিআইডিসি বাজারে গিয়ে একটি হোটেলে নাস্তা করি। তারপর আমরা চাপুলিয়ায় কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করি। পরে একটি রিকশা নিয়ে ভানুয়া যাই। সেখানে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর রাত ১১/১২টার দিকে একটি হায়েস
গাড়িতে করে তোহা ভাই, মাছুম ভাই, জান্নাতুল ও অপরিচিত দুই জন আসেন। ওই গাড়িতে গ্যাসের সিলিন্ডার, অক্সিজেন সিলিন্ডার ও দুটি ব্যাগে অনেক যন্ত্রপাতি নিয়ে আসেন।’
জবানবন্দিতে মেহেদী হাসান বলেন, ‘আমরা সবাই মিলে গাড়ি থেকে গ্যাস সিলিন্ডার ও যন্ত্রপাতি নামিয়ে বনখরিয়া রেলাইনের ওপর নিয়ে যাই। আমাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়—দক্ষিণ দিক থেকে কেউ আসে কিনা দেখার জন্য। তারপর ঢাকা থেকে আসা অপরিচিত দুজন লোক সিলিন্ডার ও যন্ত্রপাতি সেটআপ দিয়ে রেললাইনের ১৫ ফিটের মতো লাইন কেটে ফেলে। পরে সবাই মিলে সেই লাইন সরিয়ে ফেলা হয়। পরে গাড়িতে করে আমরা সবাই ঢাকা মেডিক্যাল
কেউ আসে কিনা দেখার জন্য। তারপর ঢাকা থেকে আসা অপরিচিত দুজন লোক সিলিন্ডার ও যন্ত্রপাতি সেটআপ দিয়ে রেললাইনের ১৫ ফিটের মতো লাইন কেটে ফেলে। পরে সবাই মিলে সেই লাইন সরিয়ে ফেলা হয়। পরে গাড়িতে করে আমরা সবাই ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল এলাকায় চলে আসি। সেখানে অপরিচিত দুই জন গাড়ি থেকে নেমে যায়। তোহা গাড়িটি ছেড়ে দেওয়ার পর আমাকে ৫০০ টাকা দেন। পরে আমি প্রথমে মিরপুর যাই। তারপর ওখান থেকে গাজীপুরে চলে আসি।’
আদালতে দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে জান্নাতুল ইসলাম বলেৌন, ‘১২ ডিসেম্বর তোহা ভাই আমাকে ফোন দিয়ে কোথায় আছি জানতে চান। আমি ইন্টারনেট তারের সংযোগ দেওয়ার কাজ করছিলাম। রাত ৯টারদিকে তোহা ভাই আমাকে ফোন দিয়ে আমিরা মসজিদের সামনে যেতে বলেন। আমি মসজিদের সামনে গিয়ে দাঁড়াই। কিছুক্ষণ পরে তোহা ভাই একটি সাদা হায়েস গাড়ি নিয়ে আমার সামনে আসেন। আমাকে গাড়িতে উঠতে বলেন। গাড়ির মধ্যে তোহা ভাইসহ মোট সাত জন ছিলেন। তোহা, কোনাবাড়ির মাসুম এবং আরও পাঁচ জন ছিলেন। গাড়ির পেছনে একটি গ্যাস সিলিন্ডার, একটি অক্সিজেন সিলিন্ডার ও দুটি ব্যাগ ছিল। আমরা বিআইডিসি বাজারে গিয়ে নাস্তা করি। এ সময় তোহা ভাই কাদের যেন ফোন করে দেড়ঘণ্টা পর কাজ শুরু হবে বলে জানান। আমরা সবাই মিলে গাড়িতে বনখাড়িয়ার পাশে চলে যাই। সেখানে গিয়ে দেখি মঈন, মেহেদী ও রাব্বি আগে থেকেই দাঁড়িয়ে আছে। আমরা ওইখানেরেললাইনের পাশে দেড়ঘণ্টা হাঁটি।’
উদ্ধার করা হচ্ছে দুর্ঘটনা কবলিত মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস (ফাইল
জান্নাতুল বলেন, ‘আমার হাতে ও তোহা ভাইর হাতে একটি করে ব্যাগ ছিল। মঈনের হাতে একটি গ্যাস সিলিন্ডার, মেহেদীর হাতে ছিল অক্সিজেন সিলিন্ডার। রাত ২টা ৪০ মিনিটে আমরা বনখরিয়া চিলাই ব্রিজের পাশে গিয়ে রেললাইন কাটা শুরু করি। ঢাকা থেকে যে দুজন এসেছিল, তারা মূলত রেললাইন কাটায় পারদর্শী ছিল। আমরা তাদের সহযোগিতা করি।’
আলোচিত এ ঘটনার রহস্য উন্মোচন ও গ্রেফতার অভিযানে নেতৃত্ব দেওয়া গাজীপুর মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (উত্তর) এডিসি শাহাদত হোসেন সুমা জানান, ঢাকা থেকে যে দুজন ওয়েলডিং মিস্ত্রিকে নেওয়া হয়েছিল, তাদেরগ্রেফতারের জন্য অভিযান চালানো হচ্ছে। ওই দুই যুবক পলাতক আসামি মাসুমের এক বন্ধুর ওয়েলডিং কারখানায় কাজ করতো। গোয়েন্দাদের ধারণা, ওই দুজনকে অর্থের বিনিময়ে ভাড়া করে নেওয়া হয়েছিল।