স্টাফ করেসপন্ডেন্ট
ট্যারিফ ভ্যালুর পরিবর্তে ইনভয়েস ভ্যালুতে শুল্ক মূল্যায়ণ করে দাম নির্ধারণ চান উদ্যোগক্তারা
• বর্তমানে ট্যারিফ ভ্যালুতে শুল্ক মূল্যায়ণ করে প্রাইসিং করা হচ্ছে
• ট্যারিফ ভ্যালুতে প্রাইসিং ফর্মুলা থাকলে তেল পাচার রোধ সম্ভব হবে না
• প্রাইসিং ফর্মুলা পরিবর্তন না করলে স্বয়ংক্রিয় মূল্য নির্ধারণ পদ্ধতি বাস্তবায়নে বাধাগ্রস্থ হবে
• তেল পাচার রোধে ইনভয়েস ভ্যালুতে শুল্ক মূল্যায়ণ করে প্রাইসিং ফর্মুলা প্রণয়ন করার বিকল্প নেই বলছেন বিশেষজ্ঞরা
• অবাধে পাচার হচ্ছে আমদানিকৃত জ্বালানি তেল, অপচয় হচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রা, চাপ পড়ছে রিজার্ভে
• কলকাতার জ্বালানি তেলের দামের সঙ্গে মূল্য সমন্বয় করার পরামর্শ সংশ্লিষ্টদের
• দেশে বর্তমানে জ্বালানি তেলের চাহিদা প্রায় ৭৫ লাখ মেট্রিক টন
• জ্বালানি তেলের চাহিদার প্রায় ৭৫ শতাংশই ডিজেল
ঢাকা: প্রতিবেশী দেশসহ বিশ্বের প্রায় সব দেশই এখন জ্বালানি তেলের দাম আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সমন্বয় করে বিক্রি করছে। যখন আন্তর্জাতিক বাজারে বেড়ে যাচ্ছে তখন দেশের বাজারেও বাড়ছে।আবার আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমলে দেশের বাজারেও কমিয়ে আনা হয়। এখন প্রায় প্রত্যেকটি দেশ এভাবে চলছে।
এতে তেল পাচারের ঝুঁকিটা থাকে না। কিন্তু বাংলাদেশই উল্টো পথে চলছে।যার কারণে যখন বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে যায়, তখন পার্শ্ববর্তী দেশগুলোয় জ্বালানি তেলের দামে ব্যাপক পার্থক্য তৈরি হয়। এতে বাংলাদেশ থেকে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোয় তেলের পাচার বেড়ে যায়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জ্বালানি তেলের দাম বিশ্ববাজারের সঙ্গে স্বয়ংক্রিয় সমন্বয় পদ্ধতি চালু করার আগেই ইনভয়েস ভ্যালুতে শুল্ক মূল্যায়ন করে প্রাইসিং ফর্মুলা প্রণয়ন করতে হবে। তাহলে তেল পাচার রোধ করা সম্ভব হবে। তা না হলে কোনোভাবেই এই তেল পাচার বন্ধ করা সম্ভব হবে না বলেও তারা জানান।
খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বর্তমানে জ্বালানি তেল ট্যারিফ ভ্যালুতে শুল্ক মূল্যায়ন করে প্রাইসিং ফর্মুলা করা হচ্ছে। এই প্রাইসিং ফর্মুলা থাকলে কখনওই তেল পাচার রোধ সম্ভব হবে না। এমনকি স্বয়ংক্রিয় মূল্য নির্ধারণ পদ্ধতিও বাস্তবায়ন হবে না। কারণ ইনভয়েস ভ্যালুতে শুল্ক মূল্যায়ন করে মূল্য পরিশোধ করে, ট্যারিফ ভ্যালুতে শুল্ক মূল্যায়ন করে (ব্যারেল প্রতি ৪০ ডলারে) মূল্য নির্ধারণ করা হচ্ছে।
খাত সংশ্লিষ্টরা আরও বলছেন, আমরা এলসি করার সময় বেসরকারি ব্যাংকগুলো ডলারের মূল্য ১১০ টাকা হারে ধরলেও পেমেন্ট করার সময় তাদেরকে দিতে হচ্ছে ১২৫ টাকা। এতে প্রতি ডলারে বাড়তি ১৫ টাকা দিতে হচ্ছে তেলের কাঁচামাল আমদানিকারকদের। বিপিসি জ্বালানি আমদানিতে ট্যারিফ ভ্যালু হিসেবে যে পরিমাণ শুল্ক (৪০ ডলার) দিচ্ছে, বেসরকারি পর্যায়ের তার চেয়ে ৫০ শতাংশের বেশি শুল্ক দিতে হচ্ছে। এতে ভ্যাট-ট্যাক্স দিতে হচ্ছে, যা মুক্তবাজার অর্থনীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
জ্বালানি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে স্বয়ংক্রিয় মূল্য নির্ধারণ পদ্ধতি (অটোমেটেড প্রাইসিং ফর্মুলা) কার্যকর করার শর্ত দিয়েছিল। আইএমএফর শর্ত পূরণে ডিজেল, পেট্রল, অকটেনসহ জ্বালানি তেলের দাম বিশ্ববাজারের সঙ্গে মিল রেখে নিয়মিত সমন্বয় করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। শুরুতে এটি তিন মাস পরপর নির্ধারণের পরিকল্পনা ছিল। তবে এখন প্রতি মাসে দাম নির্ধারণের চিন্তা চলছে। স্বয়ংক্রিয়ভাবে মূল্য সমন্বয়ের প্রক্রিয়াটির এখন চূড়ান্ত পর্যায়ের কাজ করছে বিপিসি।
জানতে চাইলে পারটেক্স পেট্রো কেমিক্যালের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সুবীর কুমার ঘোষ বলেন, প্রথমত, সমন্বয়ের অভাবে আমরা ট্যারিফ মূল্য পাচ্ছি না। ট্যারিফ মূল্য না পাওয়ায় আমরা প্রকৃত মূল্যের ওপর ডিউটি দিতে হচ্ছে। ফলে আমাদের খরচ বেশি হয়ে যাচ্ছে। আমরা পাঁচটি কোম্পানি শতভাগ তেল বিপিসিকে দেই, অর্থাৎ আমরা সরকারের একটা অংশ। দ্বিতীয়ত, সরকার ট্যারিফ ভ্যালু ঘোষণা করার পরেও ট্যারিফ ভ্যালুতে যেতে পারছি না, ফলে বিশ্ববাজারে তেলের দাম কমার পরেও আমরা তেলের দাম কমাতে পারছি না। আমরা পাঁচটি কোম্পানি তেলের যখন কাঁচামাল আমদানি করি, তখন আমরা প্রকৃত মূল্যের ওপর ডিউটি দিয়ে আসতে বাধ্য হচ্ছি, সেখানে সরকার যখন আমদানি করে, তখন সরকার ট্যারিফ ভ্যালুর ওপর ডিউটি দিচ্ছে। এতে আমরা একটা ডিস্ক্রিমিনেশনে পরে যাচ্ছি। আমাদের কথা হচ্ছে আইন সবার জন্যে সমানভাবে প্রযোজ্য হোক। সরকারি বা বেসরকারি সবার জন্য এক আইন প্রযোজ্য হোক।
জ্বালানি তেলের ডাইনামিক প্রাইসিং বিষয়ে জানতে চাইলে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, আমরা বেসরকারিখাতে তেলের বাজার ছেড়ে দিয়েছি। চলতি বছর এপ্রিলের মধ্যে দেশে জ্বালানি তেলের বাজারে ডাইনামিক প্রাইসিং ব্যবস্থা চালু হবে।
তিনি আরও বলেন, আমরা অধিকাংশই পরিশোধিত তেল আমদানি করি, যা আমাদের জন্য ব্যয়বহুল হয়ে পড়ে। আমরা বেসরকারিখাতে রিফাইনারি উন্মুক্ত করে দিচ্ছি। একইসঙ্গে ডিস্ট্রিবিউশনও আমরা উন্মুক্ত করে দিচ্ছি।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের সাবেক অধ্যাপক ড. ইজাজ হোসেন বলেন, জ্বালানি তেলের দাম বিষয়ে বাংলাদেশে কখনওই সুষ্ঠু প্রাইসিং সিস্টেম ছিল না। মন্ত্রণালয় যখন মনে করেছে প্রাইস বাড়ানো কিংবা কমানো দরকার তখন তারা সেভাবেই করেছে। এটাকে বলা হয় অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ প্রাইসিং। তারা সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রাইসটা জানিয়ে দিল। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এই সিস্টেম আর নেই। এমনকি আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত অনেক আগেই ফর্মুলা বেইজড সিস্টেমে চলে গিয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারেও দাম বেড়ে গেলে বেড়ে যাবে, কমলে কমে যাবে। আমরা আমাদের দেশে এমন ফর্মুলা এলপিজি গ্যাসের ক্ষেত্রে ব্যবহার করছি। প্রত্যেক মাসের প্রথম সপ্তাহে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন থেকে একটা প্রাইজ দিয়ে দেওয়া হয়। আগের মাসের প্রতিদিনের যে দাম ছিল, তার একটি গড় করে দাম নির্ধারণ করা হয়। এতে আমরা দেখছি, এলপিজি গ্যাসের দাম বাড়লে ভোক্তা পর্যায়ের দাম বেড়ে যায়। কমলে কমে যায়। অনুরূপভাবে, আমরা জ্বালানি তেলের দামও নির্ধারণ করতে পারি।
তিনি বলেন, বর্তমানে দাম নির্ধারণে ট্যারিফ ভ্যালুর যে মেকানিজম আছে, সরকার আমদানি করে একটা জিনিস নিয়ে আসে, নিয়ে আসার পর এর সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের ভ্যাট-ট্যাক্স যুক্ত করে, তারা নিজেরাই ঠিক করে এটার দাম কত হবে। সাধারণত দেখা যায়, কোনো কিছুর যখন উচ্চমূল্য থাকে, তখন এই ফর্মুলা করে। ধরলাম, ব্যারেলের দাম যখন ১০০ ডলার তখন এটা করল, যখন এটা ৮০ ডলার হয়ে গেল, তখন একটা পরিমাণ টাকা উদ্বৃত্ত রয়ে গেল এবং সেই উদ্বৃত্ত টাকা বিপিসির পকেটে চলে যায়। বিপিসি যদি সেই টাকা সংরক্ষণ করে দাম বেড়ে গেলে সেই টাকা থেকে সমন্বয় করত, তাহলে এই সমস্যা থাকত না।
ইজাজ হোসেন আরও বলেন, ট্যারিফ ভ্যালুতে আমরা দেখেছি, ভোক্তারা একটা ফিক্সড ভ্যালুতে তেল পায়। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমে গেলেও সেই মূল্যই ভোক্তাদের কিনতে হয়। আমরা যদি ইনভয়েস ভ্যালুতে চলে আসি, তাহলে আন্তর্জাতিক বাজারে গত এক মাসে আমদানি করা পণ্যের মূল্য কত, সেই আমদানি মূল্যের একটা গড় করা হবে। সেই গড় মূল্যের সঙ্গে সরকারের যে ভ্যাট-ট্যাক্স আছে সেগুলো যোগ করে দেওয়া হবে। এরসঙ্গে আর কিছুই যোগ হবে না। এমতাবস্থায় আমাদের ইনভয়েস ভ্যালুর ওপর স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে যাওয়াই ভালো।
তিনি আরও বলেন, আমি
আমি শুনেছি এর সঙ্গে বিপিসির একটা মুনাফার কথা বলা হচ্ছে। এটা আমি কখনও নেব না। এতে যেটা হবে, আমরা দেখব আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়লে, আমাদের দাম বাড়বে, কমলে আমাদেরও কমবে। এলপিজি গ্যাসের ক্ষেত্রে যেমন, তেলের ক্ষেত্রেও তেম দাম নির্ণয় হবে। এই পদ্ধতিতে দাম কমলে ভোক্তারা সুবিধা পাবে।
এই জ্বালানি বিশেষজ্ঞ বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করে স্বয়ংক্রিয়ভাবে দাম নির্ধারণ করার ক্ষেত্রে ভারত যে ফর্মুলা নির্ধারণ করছে সেই ফর্মুলায় আমাদের যেতে হবে। এতে দেখা যাবে, প্রতিমাসে তেলের দাম পরিবর্তন হচ্ছে। এতে দাম কমলে ভোক্তারা সুবিধা পাবে। এটা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে গিয়েছে। আমি অনেক দিন ধরেই বলছি, কিন্তু তারা লাভটা ছাড়তে চায় না।
আইএমএফর কথা উল্লেখ করে অধ্যাপক ইজাজ হোসেন বলেন, এই ফর্মুলা যেন শুধরানো হয়। যাতে জ্বালানি তেলে ভর্তুকি না দিতে হয়। আবার ভোক্তাদেরও যেন অতিরিক্ত টাকা দিতে না হয়। ভারতে প্রতিদিন দাম সমন্বয় করা হয়। ভারতের ভোক্তারা এতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছে। আমি মনে করি, আমাদেরও স্বয়ংক্রিয় দাম নির্ধারণের পদ্ধতি চালু করা উচিৎ। এই পদ্ধতি অনুসরণ করলে চোরাচালানও কমে যাবে।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের নির্বাহী চেয়ারম্যান মাশরুর রিয়াজ মনে করেন রাষ্ট্রায়ত্ত জ্বালানি প্রতিষ্ঠান বিপিসির দীর্ঘ মেয়াদী লোকসান কমিয়ে আনতেই প্রাতিষ্ঠানিক ভাবেই আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করে দাম কমানো হচ্ছে না। জ্বালানি খাতের এই ট্যারিফ বেইসড প্রাইসিংকে ‘ওয়ান ওয়ে টিকেট’ উল্লেখ করে বিশ্বব্যাংকের সাবেক এই অর্থনীতিবিদ বলেন, আমাদেরও দেশে শুধু বিশ্ববাজারে মূল্যবৃদ্ধিকেই অনুসরণ করা হয়, যা অনেকটা ওয়ান ওয়ে টিকেট। আমাদের মনে রাখতে হবে কৃষি, উত্পাদনমুখী শিল্প, ফ্রেইট কস্ট (পরিবহন খরচ) সহ ব্যাক্তিপর্যায়ে জ্বালানির প্রভাব ব্যাপক।
সার্বিক অর্থনীতিকে স্থিতিশীল রাখতে আন্তর্জাতিক বাজারের মূল্য পরিস্থিতি অনুযায়ী দাম নির্ধারণের বিকল্প নেই। জ্বালানির মূল্য না বাড়িয়ে রাষ্ট্রায়ত্ত জ্বালানি প্রতিষ্ঠানগুলোর দুর্নীতি ও কাঠামোগত দুর্বলতা কমানোর পরামর্শ দিয়েছেন অর্থনীতিবিদ মাশরুর রিয়াজ।