মিয়ানমার ও মনিপুরে লুট হওয়া অস্ত্র সীমান্ত পেরিয়ে দেশে ঢোকার শঙ্কা

ভারতের মনিপুর রাজ্যে গত কয়েক মাসে প্রায় ছয় হাজার অস্ত্র লুট হয়েছে। এর মধ্যে দুই হাজার অস্ত্র উদ্ধার করা হলেও বাকি চার হাজার অস্ত্র এখনও বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর হাতে রয়েছে। এর মধ্যে মাসখানেক ধরে মিয়ানারের উত্তরাঞ্চলের রাজ্যগুলোতেও সেনাবাহিনীর সঙ্গে বিভিন্ন সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের  সংঘর্ষ চলছে। মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর অত্যাধুনিক অনেক অস্ত্রও এখন সশস্ত্র গোষ্ঠীর হাতে। দেশের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, সীমান্ত পেরিয়ে এসব অস্ত্র দেশের ভেতরে আসতে পারে। এজন্য আগে থেকেই সীমান্ত জেলাগুলোতে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। এসব অস্ত্র যাতে আসন্ন নির্বাচনে ব্যবহার হতে না পারে, সেজন্যও নেওয়া হয়েছে আগাম সতর্কতা। নির্বাচন উপলক্ষে ইতোমধ্যে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারের জন্য জেলা পুলিশসহ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সব ইউনিটকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

পুলিশ সদর দফতরের উপ-মহাপরিদর্শক (ডিআইজি অপারেশন্স) আনোয়ার হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বাইরের কোনও অস্ত্র যেন দেশে প্রবেশ করতে না পারে, সেজন্য আমরা সব সময় সীমান্ত জেলাগুলোকে সতর্ক থাকতে বলি। এছাড়া সীমান্তের দায়িত্ব বিজিবির, তারাও এ বিষয়ে সতর্ক রয়েছে।’

নির্বাচনকে সামনে রেখে অস্ত্র উদ্ধারে বিশেষ অভিযান সম্পর্কে পুলিশের এই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, ‘বিশেষ অভিযানের কোনও ঘোষণা এখনও দেওয়া হয়নি। তবে মৌখিকভাবে সব জেলার পুলিশ সুপার ও অন্যান্য ইউনিটগুলোকে অস্ত্র উদ্ধারে জোর দিতে বলা হয়েছে। নিয়মিত কাজের অংশ হিসেবে অস্ত্র উদ্ধারেও অভিযান চালানো হচ্ছে।’

সম্প্রতি পুলিশ সদর দফতরে অনুষ্ঠিত ত্রৈমাসিক অপরাধ পর্যালোচনা সভায় মনিপুরে লুট হওয়া অস্ত্র দেশে ঢোকা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করা হয়। ওই সভায় পুলিশ সদর দফতরের অতিরিক্ত আইজিপি (ক্রাইম অ্যান্ড অপস) বলেন, ভারতের মনিপুরে অস্ত্র লুট হয়েছে। মনিপুরের সীমান্তের কাছাকাছি বাংলাদেশের যেসব জেলা আছে, তাদের সতর্ক থাকতে হবে— যাতে এসব লুট হওয়া অস্ত্র সীমান্ত দিয়ে প্রবেশ করতে না পারে। সভার সিদ্ধান্তেও বিষয়টি নথিভুক্ত করা হয়েছে। ওই সভায় চলতি বছরের এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ছয় মাসে প্রায় ৭০০ আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে বলেও জানানো হয়।

চলতি বছরের মে মাস থেকে আগস্ট মাস পর্যন্ত দুই দফায় ভারতের মনিরপুরে সরকারি বাহিনীর প্রায় ছয় হাজার আগ্নেয়াস্ত্র লুট করে সেখানকার সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো। ভারতীয় কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে একাধিক গণমাধ্যম জানিয়েছে, লুট হওয়া ছয় হাজার অস্ত্রের মধ্যে দুই হাজার অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। বাকি অস্ত্রগুলো সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর কাছে রয়েছে। এ কে সিরিজের এসব অস্ত্রগুলোর মধ্যে বেশিরভাগই অত্যাধুনিক রাইফেল ও পিস্তল।

অস্ত্র লুট করা সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে কুকি-চিন নামে একটি পাহাড়ি সশস্ত্র গোষ্ঠী অন্যতম। এই সশস্ত্র গোষ্ঠী বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চলেও বেশ কয়েক বছর ধরে তৎপরতা চালিয়ে আসছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কুকি-চিনের মাধ্যমে লুট হওয়া অস্ত্র দেশে ঢোকার শঙ্কা রয়েছে। এর আগে কুকি-চিননের সদস্যদের পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলাদেশে একটি নতুন জঙ্গি গোষ্ঠী জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারকিয়া পাহাড়ি এলাকায় তাদের সাংগঠনিক ও প্রশিক্ষণ কার্যক্রম শুরু করেছিল।

সংশ্লিষ্টরা জানান, ভারতের মনিপুরের সঙ্গে বাংলাদেশের সরাসরি কোনও সীমান্ত নেই। মনিপুর থেকে মিজোরাম অথবা ত্রিপুরা হয়ে বাংলাদেশে আসতে হয়। ত্রিপুরা ও মিজোরামের পাহাড়ি অঞ্চলে সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর আধিপত্য রয়েছে। ভারতের ত্রিপুরার সীমান্তে বাংলাদেশের কুমিল্লা জেলা।  এই জেলার পুলিশ সুপার আব্দুল মান্নান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সীমান্তবর্তী জেলা হিসেবে আমরা সবসময় সতর্ক ও বিশেষ নজরদারি করে থাকি। এখন যেহেতু নির্বাচনের মৌসুম। এই সময়ে আরও বেশি নজরদারি করা হচ্ছে। বাইরে থেকে অস্ত্রসহ কোনও ধরনের অবৈধ কিছু যাতে দেশে ঢুকতে না পারে, সেজন্য সতর্ক নজরদারি করা হয়। এছাড়া বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) সঙ্গেও সমন্বয় করে আমরা কাজ করছি।’

সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, শুধু মনিপুরে লুট হওয়া অস্ত্রই নয়, সাম্প্রতিক সময়ে মিয়ানমারের জান্তা সরকারের সেনাবাহিনীর সঙ্গে সেখানকার বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠীর সঙ্গে সংঘর্ষ চলছে। এসব সশস্ত্র গোষ্ঠীর বিচরণ রয়েছে বাংলাদেশের পাবর্ত্য এলাকাতেও। ফলে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর কাছ থেকে লুট করা অস্ত্রও বাংলাদেশে ঢোকার শঙ্কা রয়েছে। এছাড়া মিয়ানমারের মংডুসহ অন্যান্য অঞ্চলে বাংলাদেশের অনেকেই গিয়েছে। তারাও ফেরার সময় অস্ত্র নিয়ে আসতে পারে।

পুলিশ সদর দফতরের দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা জানান, কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো থেকে অনেকেই মিয়ানমারের উত্তরাঞ্চলের এলাকায় নিয়মিত যাতায়াত করে বলে তাদের কাছে তথ্য রয়েছে। তারা অস্ত্রও আনা-নেওয়া করছে। এসব অস্ত্র রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ভেতরে বা পাহাড়ি এলাকায় মাটির নিচে পুঁতে রাখা হয়েছে। কিন্তু রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোর ভেতরে সবসময় অভিযান চালানো সম্ভব নয়। এজন্য এসব অস্ত্র রোহিঙ্গা ক্যাম্প বা পাহাড়ি এলাকা থেকে ছড়িয়ে পড়ার শঙ্কা রয়েছে।

পুলিশ সদর দফতরের দায়িত্বশীল এই কর্মকর্তা জানান, এবারের জাতীয় নির্বাচনে আগের মতো অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার হবে বলে তারা মনে করছেন না। তবে অস্ত্রগুলো বিভিন্ন সন্ত্রাসী বা জঙ্গিদের হাতে গিয়ে পড়তে পারে। এই বিষয়টি নিয়ে তাদের মধ্যে উদ্বেগ রয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, বাংলাদেশে রাজনৈতিক সহিংসতা, হত্যা, আধিপত্য বিস্তার, চাঁদাবাজি ও মাদক ব্যবসার নিয়ন্ত্রণের জন্য অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার হয়। এসব অস্ত্রের বেশিরভাগই আগে ভারত থেকে। কিছু অস্ত্র আসে মিয়ানমার থেকে। এছাড়া বাংলাদেশের কক্সবাজারের মহেশখালী, চকরিয়াসহ পার্বত্য এলাকায় অস্ত্র তৈরিও করা হয়। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের চার হাজার ৪২৭ কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্ত রয়েছে। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সীমান্ত দিয়েও ভারত থেকে প্রচুর অস্ত্র আসে। ভারতের বিহারের মুঙ্গের এলাকায় তৈরি হয় এসব অস্ত্র।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *