এটি বিশ্বের মুসলমানদের অন্যতম বড় জমায়েত
দুই পর্বের ইজতেমায় দেশীয় মুসল্লিদের সঙ্গে বিদেশি মুসল্লিরা সমবেত হবেন এবাদত-বন্দেগি ও আল্লাহকে খুশি করার মাধ্যমে পরকালের চিরশান্তির আশায়/ফাইল ছবি
টঙ্গীর তুরাগ নদের তীরে শুরু হতে যাচ্ছে তাবলীগ জামাতের শীর্ষ জমায়েত বিশ্ব ইজতেমা। গত কয়েক বছরের ধারবাহিকতায় এ বছরও দুই পর্বে অনুষ্ঠিত হবে বিশ্ব ইজতেমা অনুষ্ঠিত হবে। ইজতেমার প্রথম পর্ব ২ থেকে ৪ ফেব্রুয়ারি এবং দ্বিতীয় পর্ব ৯ থেকে ১১ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত হবে।
প্রথম পর্বের ইজতেমায় মাওলানা জুবায়ের আহমদ পক্ষের অনুসারীরা অংশ নেবেন। দ্বিতীয় পর্বে অংশ নেবেন মাওলানা ওয়াসিফুল ইসলাম পক্ষের অনুসারীরা।
৫০ বছরের বেশি সময় ধরে সাধারণত ডিসেম্বরের কিংবা জানুয়ারি মাসে এই জমায়েত বাংলাদেশে হয়ে আসছে। তবে এ বছর জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কারণে তা কিছুটা পিছিয়ে দেওয়া হয়।
মুসলমানদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় জমায়েত বলা হয় হজকে। আর এই বিশ্ব ইজতেমাকে বলা হয় মুসলমানদের দ্বিতীয় বড় জমায়েত। লাখ লাখ মানুষ এই ইজতেমায় অংশ নেন, যাদের মধ্যে বিদেশীদের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য।
অর্ধ শতকের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশে এই ইজতেমা হলেও এর গোড়াপত্তন হয় ভারতে। বাংলাপিডিয়ার তথ্যের বরাত দিয়ে বিবিসি বাংলা বলছে, ১৯২৬ সালে হযরত মাওলানা ইলিয়াস ভারতের উত্তর প্রদেশের মেওয়াত এলাকায় তাবলীগী আন্দোলনের গোড়াপত্তন করেন এবং একইসঙ্গে এলাকাভিত্তিক সম্মিলন বা ইজতেমার আয়োজন করেন। কালক্রমে তাবলীগ সমগ্র উপমহাদেশে বিস্তার লাভ করে এবং উপমহাদেশের বাইরেও এর প্রভাব পড়ে। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের সূত্র ধরে উপমহাদেশের ভারত, পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তান – এ তিনটি অঞ্চলে মুসলমানদের অবস্থান সাপেক্ষে তাবলীগের তিনটি কেন্দ্র স্থাপিত হয়।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের শিক্ষক এবং লেখক এ কে এম খাদেমুল হক বিবিসি বাংলাকে বলেন, “১৯২০ সালের দিকে যখন এটি শুরু হয়েছিল তখন এটা একটা আন্দোলন হিসেবে শুরু হয়েছিল ভারতে। একটা বিশেষ পরিস্থিতিতে এটা শুরু হয়েছিল। তখন হিন্দুদের মধ্যে একটা সংস্কার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। হিন্দু ধর্ম থেকে যারা অন্য ধর্মে চলে যাচ্ছিল তাদেরকে আবারও হিন্দু ধর্মে ফিরিয়ে নেওয়ার একটা চেষ্টা ভারতবর্ষে বিভিন্ন প্রদেশে শুরু হয়। এটা একটা প্রক্রিয়া যেটাকে আন্দোলন বলা যায়। তখন মুসলমানদের সংখ্যা কমে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল। তখন দেওবন্দ কেন্দ্রীক মুসলমানেরা চিন্তা করলেন মুসলমানদের ইসলাম সম্পর্কে আরো সচেতন করে তুলতে হবে। এটাকে আন্দোলন বলা হয় এই অর্থে যখন একটা গোষ্ঠী অনেক লোক নিয়ে একটা নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য নিয়ে সংগঠিত করে তখন সেটা আন্দোলনের রূপ নেয়।”
তিনি আরও বলেন, “যখন এই আন্দোলন শুরু হয়েছিল তখন ব্রিটিশরা ভারতবর্ষ শাসন করছে। তাবলীগ জামাত কখনোই নিজেদেরকে ব্রিটিশ বিরোধী হিসেবে প্রচার করতে চায়নি।”
ইজতেমার বাংলাদেশ পর্ব শুরু যেভাবে
বিবিসি বাংলা বলছে, বাংলাদেশে ইজতেমার সূত্রপাত হয় ১৯৪০-এর দশকের শেষের দিকে। চট্টগ্রামের সমুদ্রবন্দর দিয়ে হজে যাওয়ার জন্য মানুষ সেখানকার হজ ক্যাম্পে জড়ো হতেন, আর সেখান থেকেই শুরু হয়েছিল আঞ্চলিক ইজতেমা।
বাংলাদেশে প্রথম তাবলীগের জামাত নিয়ে আসেন তাবলীগ আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ ইলিয়াসের ছেলে মোহাম্মদ ইউসুফ। ভারতের বাইরে বিভিন্ন দেশে ইসলাম প্রচারের কাজ করছিলেন মোহাম্মদ ইউসুফ। ভারত এবং পাকিস্তান দুটি আলাদা দেশ হওয়ার পর মোহাম্মদ ইউসুফ দুই দেশেই জামাত পাঠানো শুরু করলেন ইজতেমা আয়োজনের জন্য। তবে তখন ছোট আকারে ইজতেমা হত।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্ট্যাডিজ বিভাগের শিক্ষক এবং গবেষক ড. আব্দুর রশিদ বিবিসি বাংলাকে বলেন, “১৯৪৬ সালে বাংলাদেশে ঢাকার রমনা পার্কের কাছে কাকরাইল মসজিদ – যেটা সে সময় মালওয়ালি মসজিদ নামে পরিচিত ছিল – সেখানে এই সম্মেলনটা হয়। এরপরে হয়েছে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে।”
১৯৬৫ সালে ঢাকার কাকরাইল মসজিদে একটি জামাত আসে। সেখানে উপস্থিত ছিলেন তখনকার সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র মো. খান শাহাবুদ্দিন নাফিস। এরপর তিনি তাবলীগ জামাতের শুরা কমিটির উপদেষ্টা হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।
ঢাকার পর মোহাম্মদ ইউসুফ বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সফর করেন বলে জানান খান শাহাবুদ্দিন নাফিস।
তিনি বলেন, “তাবলীগের জমায়েতে অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা বাড়তে থাকার কারণে এর পরের বছর অর্থাৎ ১৯৬৬ সালে ইজতেমা হয় টঙ্গীর মনসুর জুট মিলের কাছে। এর পরের বছর ঠিক করা হয় ইজতেমা হবে টঙ্গীর তুরাগ নদের কাছে। স্বাধীনতার পরে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবর রহমান টঙ্গীতেই ১৬০ একর জমি নির্ধারণ করে দেন ইজতেমার জন্য।”
বিশ্ব ইজতেমা নাম যেভাবে হলো
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্ট্যাডিজ বিভাগের শিক্ষক এবং গবেষক ড. আব্দুর রশিদ বিবিসি বাংলাকে বলেন, “বিশ্ব ইজতেমা তাবলীগের দেওয়া নাম নয়, বরং তাবলীগের লোকজন এটাকে বার্ষিক সম্মেলন বলতেন।”
এ বিষয়ে খান শাহাবুদ্দিন নাফিস বলেন, “তাবলীগ জামাতের পক্ষ থেকে বিদেশিদের পাঠানো শুরু হয় এক সময়। যখন বিদেশ থেকে লোক আসা শুরু করল, তখন গ্রামের লোক এটাকে বিশ্ব ইজতেমা বলা শুরু করল। শুরার একজন প্রবীণ ব্যক্তি বললেন জনগণের চাহিদার ওপর আল্লাহতায়ালা বিশ্ব ইজতেমা করে দিয়েছেন।”
তিনি জানান, “বিশ্ব ইজতেমা” নাম নিয়ে তাবলীগ জামাতের মধ্যেই শুরুতে বিতর্ক ছিল। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিশ্ব ইজতেমা নামটি প্রচলিত হয়ে যায়।
বিশ্ব ইজতেমার স্থান হিসেবে বাংলাদেশ যেভাবে নির্ধারিত হলো
বিবিসি বাংলা বলছে, ইজতেমার ধারণা শুরু হয়েছিল ভারতে। ভারত ভাগের পর পূর্ব পাকিস্তানে ইজতেমা হতো। কিন্তু বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর এটি ভারত, পাকিস্তান বা অন্য কোনো দেশে না হয়ে বাংলাদেশেই স্থায়ী হয়েছে।
এ বিষয়ে খান শাহাবুদ্দিন নাফিস বলেন, “এর একটা কারণ ছিল সে সময়ে বাংলাদেশের ভিসা পাওয়া সহজ ছিল। ইজতেমার নামে কেউ ভিসা আবেদন করলে কেউ ফেরত যেত না। এটা সরকারের একটা ভালো পলিসি ছিল।”
বাংলাদেশের প্রতিটি সরকার এই ইজতেমাকে সমর্থন করেছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতির শিক্ষক এবং লেখক একেএম খাদেমুল হক বিবিসি বাংলাকে বলেন, “দুটো কারণে বিশ্ব ইজতেমার স্থায়ী ঠিকানা বাংলাদেশে হয়েছে। একটি বিশ্ব রাজনীতির মেরুকরণ। আরেকটি তাবলীগ জামাতের যে আন্দোলন সেটা পুরো দক্ষিণ এশিয়া-কেন্দ্রীক। যদিও ভারতে এর শুরু কিন্তু ভারতে মুসলিম-প্রধান দেশ না হওয়ার কারণে অনেক দেশের মুসলিমরা সেদেশে যেতে কমফোর্ট ফিল করেননি। আবার পাকিস্তানকে নিয়ে ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপট আছে
তিনি আরও বলেন, “তাবলীগের জমায়েত বাংলাদেশে শুরু থেকে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা যতটা পেয়েছে ততটা ভারত বা অন্য কোথাও পায়নি। এছাড়া সবচেয়ে কম খরচে মানুষ বাংলাদেশে আসতে পারত।”
বাংলাদেশে বিশ্ব ইজতেমা হওয়ার পিছনে কিছু রাজনৈতিক কারণও ছিল বলেও উল্লেখ করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. আব্দুর রশিদ বলেন, “ভারতের কিছু স্থানে তখনো মুসলমানদের মধ্যে শিয়া-সুন্নি মতবিরোধ ছিল। সে তুলনায় বাংলাদেশে মুসলমানদের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ছিল, যাকে একটা নিরাপদ পরিবেশ বলে মনে করেছিলেন তারা।”
তবে তাবলীগের এক সম্মেলনে ইজতেমার স্থান হিসেবে লটারির মাধ্যমে বাংলাদেশের উঠে আসে বলেও অনেকে উল্লেখ করেন। যদিও এই তথ্য নিরপেক্ষভাবে যাচাই করা সম্ভব হয়নি।
রাজনৈতিক কারণে তখন ভারতের নাগরিকরা যেমন সহজে পাকিস্তানে যেতে পারতেন না, তেমনি পাকিস্তানের নাগরিকদের জন্য ভারতে পাওয়া ছিল কঠিন একটি বিষয়। ফলে বাংলাদেশই ছিল ওই দেশ যেখানে সহজে সবাই আসা-যাওয়া করতে পারতেন বলে মনে করেন গবেষকরা।