বিমানের পেছনে বোয়িং ও এয়ারবাসের দৌড়ঝাঁপ

যুক্তরাষ্ট্রের বোয়িং কোম্পানির ১৬টিসহ ২১টি উড়োজাহাজ রয়েছে রাষ্ট্রীয় পতাকাবাহী সংস্থা বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনন্সের। আরও ১০টি উড়োজাহাজ কেনার পরিকল্পনা রয়েছে বিমানের। শুরুতে বিমানের জন্য এয়ারবাসের কাছ থেকে ১০টি উড়োজাহাজ কেনার ঘোষণা দিয়েছে সরকার। বিমানও এয়ারবাস কোম্পানির তৈরি উড়োজাহাজ কেনার কথা জানিয়েছিল। আর নিজের বাজার দখল রাখতে বোয়িং কোম্পানি বিমানকে দিচ্ছে নানা রকম প্রস্তাব।

তবে এয়ারবাস এবং বোয়িং— দুই প্রতিষ্ঠানই নানা ধরনের প্রস্তাব নিয়ে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের কাছে দৌড়ঝাঁপ করছে অর্ডার পেতে।২০০৮ সালে মার্কিন আকাশযান নির্মাতা প্রতিষ্ঠান বোয়িংয়ের সঙ্গে ২১০ কোটি মার্কিন ডলারে তিনটি মডেলের ১০টি নতুন উড়োজাহাজ কেনার চুক্তি করে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স। এর মধ্যে চারটি বোয়িং ৭৭৭-৩০০ ইআর, দুটি বোয়িং ৭৩৭-৮০০ ও চারটি বোয়িং ৭৮৭-৮ ড্রিমলাইনার উড়োজাহাজ অর্ডার দেওয়া হয়। একে একে বিমানগুলো পেতে লেগেছে প্রায় ১১ বছর। পরে বোয়িংয়ের কাছ থেকে আরও দুটি ড্রিমলাইনার উড়োজাহাজ কেনে বিমান। এর বাইরে বোম্বার্ডিয়ার ড্যাশ-৮ উড়োজাহাজ আছে পাঁচটি

কেন উড়োজাহাজ কিনতে চায় বিমান
রাষ্ট্রীয় পতাকাবাহী এয়ারলাইন্সের দেশের ভেতরে সাতটি এবং আন্তর্জাতিক ২২টি রুটে ফ্লাইট পরিচালনা করছে। আরও রুট বৃদ্ধি ও ফ্লাইট ফ্রিকোয়েন্সি বাড়ানোর পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে তারা। সম্প্রতি কানাডা, জাপান, ভারতের চেন্নাই রুটে ফ্লাইট চালু করেছে বিমান। নিউইয়র্ক, ইতালির রোমসহ আরও কয়েকটি গন্তব্যে ফ্লাইট চালু করার পরিকল্পনা বিমানের। এ ছাড়া দুবাই, সৌদি আরব, মালয়েশিয়া, চেন্নাই, কানাডায় ফ্লাইট সংখ্যাও বাড়াতে চায় বিমান।

বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং সিইও শফিউল আজিম বলেন, ব্যবসার সম্প্রসারণের প্রয়োজনেই নতুন উড়োজাহাজ কেনা প্রয়োজন। বিমানকে প্রতিযোগিতা করতে হয় এমিরেটসের সঙ্গে, সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সের সঙ্গে,কাতারের সঙ্গে। অন্যান্য এয়ারলাইন্সের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নামতে গেলে তো নতুন উড়োজাহাজ লাগবেই। মার্কেট ডিমান্ড আছে, বিমানের উড়োজাহাজ কেনার ক্যাপাসিটি আছে।

শফিউল আজিম আরও বলেন, উড়োজাহাজ আজ অর্ডার দিলেই আগামীকাল পাওয়া যাবে, বিষয়টি এমন নয়। আগের অর্ডারটি ছিল ২০০৮ সালে। তখনকার ১০টি উড়োজাহাজ পেতে সময় লেগেছে প্রায় ১১ বছর। অর্থাৎ ভবিষ্যৎ প্রয়োজনের বিষয়টি বিবেচনা করে এখনই অর্ডার করতে হবে। আগে প্রয়োজন হলে বিমান লিজ নিতো, কিন্তু বরাবরই এতে বিমানের লোকসান হয়েছে। ফলে আর কোনও উড়োজাহাজ লিজ নেওয়া হবে না।

কেন আলোচনায় এয়ারবাস
মার্কিন প্রতিষ্ঠান বোয়িংয়ের উড়োজাহাজ ব্যবহার করছে বিমান। এমনকি বিমানের নিউইর্য়ক ফ্লাইট চালুর বিষয়টি নিয়েও এই প্রতিষ্ঠানটি সহায়তা করার আশ্বাস দিয়েছে বিমানকে। সর্বশেষ ২০১৯ সালে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সকে

বিশেষ ছাড়ে দুটি ৭৮৭-৯ ড্রিমলাইনার উড়োজাহাজ দিয়েছিল। চীনের হেইনান এয়ারলাইন্স অর্ডার করলেও উড়োজাহাজ দুটি নেয়নি। সেই দুটি উড়োজাহাজ ছাড়ে বিমানকে কেনার প্রস্তাব দিলে বিমান কিনে নেয়।

বিমান-বোয়িংয়ের দীর্ঘমেয়াদি সম্পর্কের মধ্যে হঠাৎ কেন আলোচনায় এয়ারবাস, এমন প্রশ্ন অনেকের মনে। চলতি বছরের ২২ মার্চ ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয় ‘বাংলাদেশ এভিয়েশন সামিট’। সেখানে উড়োজাহাজ বিক্রির প্রস্তাব করে ফ্রান্সের উড়োজাহাজ নির্মাতা প্রতিষ্ঠান এয়ারবাস। অনুষ্ঠানের শুরুতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একটি ভিডিও বক্তব্য প্রচার করা হয়। প্রধানমন্ত্রী বলেন, এভিয়েশন খাতে আমাদের এই যাত্রায় সহায়তার জন্য এয়ারবাসের মাধ্যমে যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সের এই অংশীদারত্বের প্রস্তাব খুবই গুরুত্ববহ।

অনুষ্ঠানে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রীর বাণিজ্য দূত রুশনারা আলী বলেন, যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রীর বাণিজ্য দূত হিসেবে জানাচ্ছি যে এয়ারবাসের এই প্রস্তাবের পেছনে যুক্তরাজ্য সরকার শক্ত রাজনৈতিক সমর্থন দিতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। যুক্তরাজ্য এভিয়েশন খাতের বৈশ্বিক লিডার এবং বিভিন্ন দেশকে এভিয়েশনে সাহায্য করার অনেক ইতিহাস যুক্তরাজ্যের রয়েছে। এয়ারবাসের এই প্রস্তাব বাংলাদেশের এভিয়েশন খাতের চিত্রকে বদলে দিতে পারে।

সেই অনুষ্ঠান শেষে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মাহবুব আলী বলেছিলেন, আমাদের এয়ারবাস কেনার চিন্তা আছে। আজকের সামিটও সেটা রিফ্লেক্ট করছে। সেই সামিটে ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত রবার্ট সি ডিকসন, ফ্রান্সের রাষ্ট্রদূত মারি মাসদুপু, বেসামরিক বিমান পরিহন

ও পর্যটন সচিব মোকাম্মেল হোসেন, বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মফিদুর রহমান, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের এমডি শফিউল আজিম, এয়ারবাস ইন্ডিয়া ও সাউথ এশিয়ার প্রেসিডেন্ট রেমি মেইলার্ড উপস্থিত ছিলেন।

একই বছরের ৬ মে লন্ডনে প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান এবং যুক্তরাজ্যের বিনিয়োগমন্ত্রী লর্ড ডমিনিক জনসন এয়ারবাস থেকে যাত্রী ও পণ্যবাহী উড়োজাহাজ কেনাসহ দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতার ঘোষণাপত্র হস্তান্তর করেন। এ সময় প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব মো. তোফাজ্জল হোসেন মিয়া ও যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশ সংক্রান্ত বাণিজ্য দূত রোশনারা আলী উপস্থিত

ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ গত ১০ সেপ্টেম্বর ঢাকায় এসেছিলেন। তখনও আলোচনায় ছিল এয়ারবাস কেনার বিষয়টি। সে সময় ফরাসি প্রেসিডেন্ট বলেছেন, এয়ারবাস কোম্পানির তৈরি ১০টি উড়োজাহাজ কেনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে বাংলাদেশ। ১০টি এয়ারবাস এ৩৫০ কেনার এই প্রতিশ্রুতি গুরুত্বপূর্ণ।

বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশের ওপর নানা ধরনের চাপ প্রয়োগ করছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে মার্কিন প্রশাসনের চাপ দৃশ্যমান। এমন পরিস্থিতিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চাপ সামলাতে অন্য রাষ্ট্রের সঙ্গে বন্ধুত্ব বৃদ্ধির চেষ্টা সরকারের। এয়ারবাস ফ্রান্স ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান হলেও, ইঞ্জিনসহ অন্যান্য বিষয়ে

যুক্তরাজ্য ও জার্মানিরর অংশীদারত্ব রয়েছে। এয়ারবাস কেনার ঘোষণার মধ্য দিয়ে এই তিন দেশে সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক বেড়েছে। অন্যদিকে বাজার ফিরে পেতে মার্কিন প্রতিষ্ঠান বোয়িংও দেনদরবার শুরু করেছে।

বোয়িংয়ের দৌড়ঝাঁপ, যুক্ত হলেন রাষ্ট্রদূতও
যখনই বিমানের পক্ষ থেকে এয়ারবাস থেকে উড়োজাহাজ কেনার ঘোষণা আসে, তখনই নড়েচড়ে বসে বোয়িং। দীর্ঘ যাত্রায় কখনও বাংলাদেশে কোনও অনুষ্ঠান করতে দেখা যায়নি বোয়িংকে। সেই বোয়িং ঢাকায় সংবাদ সম্মেলন করেছে, সাংবাদিকদের নিয়ে আলোচনা করেছে তাদের উড়োজাহাজ নিয়ে।

গত ১০ মে সংবাদ সম্মেলন করে বোয়িংয়ের এশিয়া প্যাসিফিক ও ভারতের

বোয়িং কমার্শিয়াল মার্কেটিং ম্যানেজিং ডিরেক্টর ডেভ শাল্টে বলেন, বিমান যদি বর্তমানে নতুন কোনও ব্র্যান্ডের (এয়ারবাস) এয়ারক্রাফট কেনে, তাহলে তাদের খরচ অনেকাংশে দ্বিগুণ হয়ে যাবে। বর্তমানে বিমানের বহরে বোয়িংয়ের আধিক্য থাকায় বিমানের একটি টেকনিক্যাল ও পাইলট টিম রয়েছে। তবে বিমান যদি নতুন ব্র্যান্ডের এয়ারক্রাফট নেয়, সে ক্ষেত্রে তাদের দুই সেট টেকনিক্যাল টিম, দুই সেট পাইলট, দুই সেট ট্রেনিং টিম, দুই সেট সিমুলেটর লাগবে। এতে বিমানের খরচ কয়েক গুণ বাড়বে।

গেলো অক্টোবরে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন জানিয়েছেন, বিমানকে বহুমুখীকরণের অংশ হিসেবে এয়ারবাস থেকে প্লেন কেনার জন্য আলোচনা করছে সরকার। এখন বোয়িং অর্ধেক দামে প্লেন দিতে চাইছে।

বোয়িং থেকে যাতে আমরা বের না হয়ে যাই, সে কারণে একাধিক গোষ্ঠী প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছে।

সম্প্রতি বোয়িংয়ের ভাইস প্রেসিডেন্টের সঙ্গে ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাস বিমানের এমডির সঙ্গে দেখা করেছেন। ১১ ডিসেম্বর বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মো. মফিদুর রহমানের সঙ্গে ঢাকায় বৈঠক করেছেন পিটার হাস। বৈঠকে ঢাকা-নিউইয়র্ক ফ্লাইট চালু, বিমানের কাছে বোয়িং কোম্পানির ড্রিমলাইনারের নতুন ভার্সন ৭৮৭-১০ বিক্রির বিষয়েও প্রস্তাব দেন পিটার হাস।

এ প্রসঙ্গে বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শফিউল আজিম বলেন, তারা এসেছিলেন। আমরা আলোচনা করেছি। তাদের প্রস্তাবগুলো

শুনেছি।

কী করবে বাংলাদেশ বিমান
বিশ্বের প্রধান দুটি উড়োজাহাজ নির্মাতা কোম্পানি বোয়িং ও এয়ারবাস বাংলাদেশ বিমানের অর্ডার পেতে মরিয়া। দুটি নির্মাতা প্রতিষ্ঠানকে ঘিরে সংশ্লিষ্ট দেশের উচ্চ পর্যায়ের নেতা, কর্মকর্তারাও নানাভাবে তদবির চালিয়ে যাচ্ছেন।

কী সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে বাংলাদেশ বিমান, এমন প্রশ্নে বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শফিউল আজিম বলেন, আমাদের সক্ষমতা আছে জেনেই আমাদের কাছে প্রস্তাব নিয়ে এসেছে। উভয়ের (বোয়িং-এয়ারবাস) প্রস্তাবই আমাদের টেবিলে রয়েছে, কোনও কিছুই এখনও চূড়ান্ত নয়। যার কাছ থেকে ভালো দামে পাবো, যারা বেশি সুযোগ-সুবিধা দেবে, যেখানে গেলে আমাদের বেশি লাভ হবে, আমরা তার কাছেই যাবো

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *