কত টাকা থাকলে ফিতরা দিতে হবে, কাকে দিতে হবে?

সদকাতুল ফিতরা

ফিতরা আররি শব্দ, যা ইসলামে জাকাতুল ফিতর বা সদাকাতুল ফিতর নামে পরিচিত। ফিতর বা ফাতুর বলতে সকালের খাদ্যদ্রব্য বোঝানো হয়। ইসলামের পরিভাষায় সদকাতুল ফিতর বলা হয় ঈদুল ফিতর উপলক্ষে গরিব-দুঃস্থদের মাঝে রোজাদারদের পক্ষ থেকে বিশেষ দানকে।

ফিতরা আদায়ের হুকুমইসলামে সদকাতুল ফিতর বা ফিতরা আদায় করা গুরুত্বপূর্ণ একটি আর্থিক ইবাদত। এটি জাকাতেরই একটি শ্রেণি। ইসলামে এটি একটি ওয়াজিব ইবাদত। হাদিসে শরিফে বর্ণিত হয়েছে। মহানবী (সা.) এক ব্যক্তিকে নির্দেশ দিলেন, যেন সে মক্কার অলিগলিতে এ ঘোষণা দেয় ‘সদাকাতুল ফিতর ওয়াজিব’। (তিরমিজি শরিফ, পৃষ্ঠা ২/১৫১)

অন্য আরেকটি হাদিসে হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘রাসূল (সা.) সদকায়ে ফিতর নির্ধারণ করেছেন, যাতে অনর্থক কথাবার্তা থেকে রোজাগুলোর পবিত্রতা অর্জিত হয়, অনুরূপভাবে মিসকিনদের খাবারের ব্যবস্থা হয়ে যায়।’ (আবু দাউদ শরিফ)

ফিতরা কার ওপর ওয়াজিব?

কারও কাছে সাড়ে সাত ভরি স্বর্ণ বা সাড়ে বায়ান্ন ভরি রুপা অথবা তার সমমূল্যের নগদ অর্থ কিংবা নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের অতিরিক্ত সম্পদ ঈদুল ফিতরের দিন সুবহে সাদিকের সময় বিদ্যমান থাকে, তাহলে তার ওপর সদকাতুল ফিতর ওয়াজিব হবে। যার ওপর সদকাতুল ফিতর আদায় করা ওয়াজিব, তিনি নিজের পক্ষ থেকে যেমন আদায় করবেন, তেমনি নিজের অধীনদের পক্ষ থেকেও আদায় করবেন।

এমনকি রমজানের শেষ দিনেও যে নবজাতক দুনিয়ায় এসেছে তার পক্ষ থেকেও সদকাতুল ফিতর আদায় করতে হবে। আর ঈদের দিন সকালে ঈদের নামাজে যাওয়ার আগে ফিতরা আদায় করতে হয় (অগ্রিম দেওয়ারও সুযোগ রয়েছে। ফুকাহায়ে কেরাম বরং এটির পক্ষে মত দেন)। (ফাতহুল কাদির ২/২৮১)

নেছাব পরিমাণ মালের বর্তমান বাজারদর কত?

ফিতরা ও জাকাতের নেছাব অভিন্ন। দেশি-বিদেশি মুদ্রা ও ব্যবসায়িক পণ্যের নেছাব নির্ধারণে সোনা-রুপা হলো পরিমাপক। এ ক্ষেত্রে ফকির-মিসকিন ও দরিদ্রদের জন্য যেটি বেশি লাভজনক হবে, সেটিকে পরিমাপক হিসেবে গ্রহণ করাই শরিয়তের নির্দেশ। তাই মুদ্রা ও পণ্যের বেলায় বর্তমানে রুপার (২২ ক্যারেট বারের মূল্য) নেছাবই পরিমাপক হিসেবে গণ্য হবে।

চলতি মাসের (মার্চ-২০২৪) শুরুতে বাংলাদেশ জুয়েলার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বাজুস) রেট অনুযায়ী ৫২ দশমিক ৫ তোলা ২২ ক্যারেট রুপার বারের দাম হলো- প্রায় ৭৫ হাজার টাকা। (এখানে অলঙ্কার হিসেবে দাম ধরা হয়নি। কারণ, এক্ষেত্রে অলঙ্কার তৈরির মজুরি অন্তর্ভুক্ত থাকে। কিন্তু জাকাত-ফিতরা আবশ্যক হয় স্রেফ রুপার ওপর। এজন্য রুপার বিস্কুটের দাম ধরা হয়েছে)।

ফিতরা ও জাকাতের মধ্যে পার্থক্য

জাকাত ও ফিতরার মূল পার্থক্য হলো, জাকাতের ক্ষেত্রে কোনও ব্যক্তির মালিকানায় নেছাব পরিমাণ সম্পদ পূর্ণ এক বছর থাকলে তাকে সম্পদের ২.৫ শতাংশ হারে জাকাত দিতে হয়, কিন্তু ফিতরার ক্ষেত্রে সম্পদ পূর্ণ এক বছর স্থায়ী হওয়ার প্রয়োজন হয় না। বরং ঈদুল ফিতরের দিন সকালে নেছাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হলেই তার ওপর ফিতরা ওয়াজিব হয়। জাকাতের পরিমাণ হচ্ছে সম্পদের ৪০ ভাগের ১ ভাগ বা ২.৫ শতাংশ। আর ফিতরা প্রদান করতে হয় জনপ্রতি এক সা গম, যার পরিমাণ ২ কেজি ৪০ গ্রাম।

ফিতরা কাকে দিতে হবে?

জাকাত ও সদকাতুল ফিতর প্রদানের খাত একই। অর্থাৎ নির্ধারিত আটটি খাত, যা পবিত্র কোরআনে বর্ণিত হয়েছে। যাদেরকে জাকাত দেওয়া যাবে তাদের সদকাতুল ফিতরও দেওয়া যাবে।

আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘নিশ্চয় সদকা হচ্ছে ফকির ও মিসকিনদের জন্য এবং এতে নিয়োজিত কর্মচারীদের জন্য, আর যাদের অন্তর আকৃষ্ট করতে হয় তাদের জন্য, (তা বণ্টন করা যায়) দাস আজাদ করার ক্ষেত্রে, ঋণগ্রস্তদের মধ্যে, আল্লাহর রাস্তায় এবং মুসাফিরদের মধ্যে। এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত। আর আল্লাহ মহাজ্ঞানী, প্রজ্ঞাময়।’ (সুরা তাওবা, আয়াত : ৬০) কোরআনে বর্ণিত নির্ধারিত খাত ব্যতীত অন্য কোনও কাল্যাণমূলক কাজে সদকাতুল ফিতর প্রদান করলে শরিয়তের দৃষ্টিতে তা গ্রহণযোগ্য হবে না।

ফিতরা না দিলে কি গোনাহ হবে?

ফিতরা ইসলামি শরিয়তে একটি ওয়াজিব ইবাদত। আর ওয়াজিব ওই আদেশমূলক বিধানকে বলা হয়- যা অকাট্য প্রাধান্যযোগ্য দলিল দ্বারা প্রমাণিত এবং তার ওপর আমল করা অপরিহার্য। তার অকাট্যতার ওপর সুনিশ্চিতভাবে বিশ্বাস রাখা অপরিহার্য না হলেও তার ওপর আমল করা অপরিহার্য। কোনও ওজর ব্যতীত তা ত্যাগকারী গুনাহগার হবে এবং তার অস্বীকারকারী ‘ফাসিক’ বলে গণ্য করা হয়, তবে ‘কাফির’ বলা যাবে না। যথা— বিতর নামাজ, সদকাতুল ফিতর ও কোরবানি ইত্যাদি।

এ বছর সদকাতুল ফিতরের পরিমাণ

এ বছর বাংলাদেশে জনপ্রতি ফিতরার হার নির্ধারণ করা হয়েছে সর্বনিম্ন ১১৫ টাকা। আর সর্বোচ্চ ফিতরা নির্ধারণ করা হয়েছে ২ হাজার ৯৭০ টাকা। জাতীয় ফিতরা নির্ধারণ কমিটি জানিয়েছে যে, ইসলামি শরিয়াহ মতে মুসলমানরা সামর্থ্য অনুযায়ী গম, আটা, খেজুর, কিশমিশ, পনির ও যবের যেকোনও একটি পণ্যের নির্দিষ্ট পরিমাণ বা এর বাজার মূল্য ফিতরা হিসেবে গরিবদের মাঝে বিতরণ করতে পারবেন।

গম ও আটার ক্ষেত্রে এর পরিমাণ এক কেজি ৬৫০ গ্রাম (অর্ধ সা)। খেজুর, কিশমিশ, পনির ও যবের ক্ষেত্রে ৩ কেজি ৩০০ গ্রামের (এক সা) মাধ্যমে সাদাকাতুল ফিতর (ফিতরা) আদায় করতে হয়। এসব পণ্যের বাজার মূল্য হিসাব করে সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন ফিতরা নির্ধারণ করা হয়।

উন্নতমানের আটা বা গমের ক্ষেত্রে ফিতরা এক কেজি ৬৫০ গ্রাম (অর্ধ সা) বা এর বাজার মূল্য ১১৫ টাকা। যবের ক্ষেত্রে (এক সা) ৩ কেজি ৩০০ গ্রাম বা এর বাজার মূল্য ৪০০ টাকা ফিতরা দিতে হবে। এছাড়া ৩ কেজি ৩০০ গ্রাম কিশমিশ বা এর বাজার মূল্য ২ হাজার ১৪৫ টাকা দিয়ে ফিতরা আদায় করা যাবে। খেজুরের ক্ষেত্রে ৩ কেজি ৩০০ গ্রাম বা এর বাজার মূল্য ২ হাজার ৪৭৫ টাকা ও পনিরের ক্ষেত্রে ৩ কেজি ৩০০ গ্রাম বা এর বাজার মূল্য ২ হাজার ৯৭০ টাকা দিয়ে ফিতরা আদায় করতে হবে।ফিতরার পণ্যের স্থানীয় খুচরা বাজার মূল্যের তারতম্য রয়েছে। সে অনুযায়ী স্থানীয় মূল্যে পরিশোধ করলেও ফিতরা আদায় হয়ে যাবে। আল্লাহ যাদের সামর্থ্য দিয়েছেন সামর্থ্যবানরা যদি অতিরিক্ত বা এটার মধ্যে যেটার দাম বেশি সেটা দিয়ে ফিতরা আদায় করেন, তিনি আল্লাহর কাছে বেশি প্রিয় হবেন। এটা তার জন্য কল্যাণকর।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *