যশোরের ভগবানপুর গ্রামের গাছিদের তৈরি খেজুরের গুড়
একসময় খেজুরের রস ও গুড়ের বাজার ছিল গ্রামকেন্দ্রিক। এখন অনেকে চিনির বিকল্প হিসেবে গুড় খেয়ে থাকেন। এতে কয়েক বছর ধরে শহরে গুড়ের চাহিদা বেড়েছে। বিশেষ করে শীতকালে খেজুরের রসের মতো গুড়েরও চাহিদা প্রচুর। এর মধ্যে ‘যশোরের যশ খেজুরের রস’ কথাটি ঐতিহ্যবাহী। কারণ এখানের রসের ইতিহাস অনেক পুরোনো। প্রাচীনকাল থেকেই যশোর খেজুর গাছ এবং গুড়ের জন্য বিখ্যাত।
প্রতি বছর শীত মৌসুমের শুরুতে এই অঞ্চলের গাছিরা খেজুর গাছ কাটতে শুরু করেন। ইতোমধ্যে রসের পাশাপাশি গুড় বিক্রি শুরু করেছেন। এর মধ্যে গত কয়েকদিন শীতের তীব্রতায় বাড়ায় রস পাওয়ার পরিমাণ বেড়েছে। গাছিরা বলেছেন, এই সময়কালে রস যেমন পরিষ্কার হয়, তেমনি মিষ্টতাও বেশি থাকে।
চুল্লিতে খড়, শুকনো খেজুরের পাতা পুড়িয়ে রস জ্বাল দেওয়া হচ্ছেজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, এ বছর তিন লাখ ২৫ হাজার গাছ থেকে রস আহরণ করে গুড় তৈরি করা হচ্ছে। গুড় উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ১০০ কোটি ছাড়িয়ে যাবে।শনিবার (১৩ জানুয়ারি) ভোরে যশোরের চৌগাছা উপজেলার নারায়ণপুর ইউনিয়নের ভগবানপুর গ্রামের একটি খেজুরের বাগানে বেশ কয়েকজন গাছির দেখা মেলে। তারা ব্যস্ত ছিলেন গাছ থেকে রস আহরণের কাজে। ঘন কুয়াশা ঘেরা সকালে গাছে উঠে রসের হাঁড়ি (ভাড়) নামানোর যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে নিজস্ব বুদ্ধিতে তারা তৈরি করে নিয়েছেন বাঁশের লম্বা ছড়ি। নিচ থেকে ছড়িতে হাঁড়ির দড়িটিকে আটকে নামিয়ে আনছেন। সেই রস বড় কলসিতে ঢেলে আবার হাঁড়ি জুড়ে দিচ্ছেন গাছে। এই মাঠেই রয়েছে দুই শতাধিক খেজুর গাছ। এছাড়া রাস্তার দুই পাশ ও ধানক্ষেতের আইলের পাশে রয়েছে অসংখ্য গাছ।
ভগবানপুর গ্রামের মাঠের গাছ থেকে রস নামিয়েছেন ছলিম মণ্ডল
ভগবানপুর গ্রামে রস সংগ্রহে ব্যস্ত ছিলেন আবুজার রহমান, রফিকুল ইসলাম, তৌহিদুর রহমান, ওহিদুল ইসলাম ও আজিজুর রহমান। তারা সম্পর্কে চাচাতো-খালাতো ভাই। গাছ থেকে যে যার মতো হাঁড়ি নামিয়ে রস সংগ্রহে ব্যস্ত। সকাল সকাল রস বাড়ি নিয়ে কিছুটা নিজেরা খাবেন; বাকিটা জ্বাল দিয়ে গুড় তৈরি করবেন।
যেভাবে তৈরি হয় গুড়
ভগবানপুর গ্রামে গিয়ে দেখা গেছে, প্রায় প্রতিটি বাড়িতে গুড় তৈরির জন্য চুল্লি বানানো হয়েছে। গুড় তৈরির জন্য বড় কড়াই (তাফাল) ধুয়ে-মুছে পরিষ্কার করছেন। পরিষ্কার শেষে গাছের রস নিজেদের খাওয়ার অংশটুকু রেখে ছেঁকে কড়াইতে ঢালছেন। এরপর চুল্লিতে খড়, শুকনো খেজুরের পাতা পুড়িয়ে রস জ্বাল দেওয়া শুরু করেন। দীর্ঘ সময় জ্বাল দেওয়ার পর রসের ঘনত্ব ও রঙ বদলায়। এভাবে তৈরি হয়ে যায় গুড়। যিনি জ্বাল দেন, তিনি বুঝতে পারেন নামানোর সময়। বুঝতে না পারলে মুরব্বিদের কাছ থেকে জেনে নেন। ঘনত্ব বুঝে ঝোলা গুড় ও পাটালির উপযুক্ততা নির্ধারণ করেন। সাধারণত গ্রাহকের চাহিদা অনুযায়ী চাষিরা গুড়ের প্রকারভেদ নির্ধারণ করেন। এই গ্রামের অধিকাংশ পুরুষ কৃষিকাজের পাশাপাশি এই পেশায় জড়িত।
ঘনত্ব বুঝে ঝোলা গুড় ও পাটালির উপযুক্ততা নির্ধারণ করেন গাছিরা
গাছিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২০২৩ সালের নভেম্বর মাস থেকে গাছ কাটা এবং রস সংগ্রহের মৌসুম শুরু হয়েছে। তখন শীতের তীব্রতা কম থাকায় রসের পরিমাণ কম ছিল। ফলে রস ও গুড়প্রেমীদের চাহিদা মতো সরবরাহ করা সম্ভব হতো না। তবে চলতি বছরের জানুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে যশোরে শীতের তীব্রতা বেড়েছে। এতে আগের তুলনায় রসের পরিমাণ বেড়েছে। ফলে ক্রেতাদের চাহিদা মিটিয়ে লাভের মুখ দেখছেন তারা।
গুড়ের কেজি ৩০০-৫০০ টাকা
ইলিশমারী গ্রামের রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘বছরের অন্যান্য সময় কৃষিশ্রমিকের কাজ করি। শীত মৌসুমে খেজুর গাছ কেটে রস সংগ্রহ করতে নামি। আমার চাচাতো-খালাতো ভাইয়েরাও এই পেশা ধরে রেখেছেন। এবার আমার গাছের সংখ্যা ৩৫টি। প্রতিদিন পাঁঁচ-ছয় হাঁড়ি গুড় বিক্রি করছি। কেজি ৩০০-৫০০ টাকা (ঝোলা-পাটালি) বিক্রি করি। প্রতি হাঁড়ি রস ২০০-২৫০ টাকা বিক্রি করছি। এতে ভালোই আয় হয়।’
ভগবানপুর গ্রামের বাসিন্দা আবুজার রহমান বলেন, ‘সকালে এই গ্রামের মধ্য দিয়ে হাঁটলে রসের মিষ্টি গন্ধে প্রাণ ভরে যায়। প্রতিটি বাড়ির সকালটা যেন উৎসবের সকাল হয়ে দাঁড়ায়। গুড় জ্বাল দেওয়ার পর শিশুরা তাফালের পাশে বসে কাঠি ও চামচ দিয়ে খেতে শুরু করে। শীতের পুরো মৌসুম চলে গুড় তৈরি ও বিক্রি।’
একই গ্রামের ওহিদুল ইসলাম বলেন, ‘এবার ৪৩টি গাছ থেকে রস সংগ্রহ করছি। শীত মৌসুমের শুরু থেকে গাছগুলো কাটছি। শনিবার সাত হাঁড়ি রস পেয়েছি। এই রস জ্বাল দিলে অন্তত পাঁচ-ছয় কেজি গুড় হবে।’
বাপ-দাদাদের কাছ থেকে খেজুর গাছ কাটা শিখেছি উল্লেখ করে ওহিদুল বলেন, ‘বংশপরম্পরায় এই পেশায় যুক্ত হয়েছি। এটি হাড়ভাঙা খাটুনির কাজ। সে তুলনায় লাভ কম। এই পেশায় সরকারের সহযোগিতা নেই বললেই চলে। এজন্য অনেকে অন্য পেশায় চলে যাচ্ছেন। ব্যাংক, এনজিও ও বেসরকারি সংস্থা যদি সহায়তা দিয়ে আমাদের পাশে থাকতো, তাহলে খেজুরের গুড়ের উৎপাদন আরও বাড়তো।’
ভগবানপুর গ্রামের মাঠের মধ্যে শীতে জবুথবু ছলিম মণ্ডলের। তিনি গাছ থেকে রস নামাচ্ছিলেন। এর ফাঁকে বলেন, ‘২০ বছর ধরে লিজ নিয়ে খেজুর গাছ কাটি। পেটের দায়ে এই পেশায় আছি। গাছের মালিকদের এই মৌসুমে দুই থেকে চার হাঁড়ি পর্যন্ত গুড় দেওয়া লাগে। নিজের গাছ নেই। রস কিংবা গুড় তৈরি করে বিক্রির পর যা আয় হয়, তা কৃষি মজুরির চেয়ে বেশি। এজন্য কষ্ট হলেও তিন মাস রস ও গুড়ের ব্যবসা করছি
গাছিদের প্রশিক্ষণ এবং সরঞ্জাম দিয়েছে কৃষি বিভাগ
এবার নিরাপদ রস সংগ্রহ এবং গুড়ের উৎপাদন বাড়াতে জেলা কৃষি বিভাগ গাছিদের প্রশিক্ষণ এবং সরঞ্জাম দিয়েছে বলে জানালেন যশোর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালক ড. সুশান্ত তরফদার।
তিনি বলেন, ‘এ বছর ১০০ কোটি টাকার খেজুরের গুড় উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে আমাদের। উৎপাদন বাড়াতে কৃষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। গাছি তৈরি, তাদের সরঞ্জাম প্রদান এবং রফতানিমুখী করার জন্য নিরাপদভাবে গুড় উৎপাদনের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। এতে গাছিরা যেমন লাভবান হবেন, তেমনই দেশের রাজস্ব বাড়বে।’
জেলা কৃষি বিভাগের তথ্যমতে, যশোরে ১৬ লাখ ২৫ হাজার ৫০০টি খেজুর গাছ রয়েছে। এর মধ্যে পূর্ণবয়স্ক গাছ ৯ লাখ ৭৫ হাজার। তার মধ্যে তিন লাখ ২৫ হাজার গাছ থেকে রস আহরণ করে তৈরি করা হচ্ছে গুড়।
রস সংগ্রহ এবং গুড়ের উৎপাদন বাড়াতে কৃষি অধিদফতর থেকে শার্শা, চৌগাছা, সদর উপজেলার ৯০ জন গাছিকে প্রশিক্ষণ, গ্লাভস, রস ঢেকে রাখা ও গুড় প্যাকিংয়ের জন্য সরঞ্জাম দেওয়া হয়েছে।