স্টাফ করেসপন্ডেন্ট
যশোর: যশোর-খুলনা মহাসড়কের উন্নয়নের কাজ শুরু করা হয় ২০১৮ সালের মে মাসে। ২০২২ সালের জুনে সড়কের কাজ শেষ করা হয়েছিল।সড়কের নির্মাণকাজ চলমান থাকাবস্থায় ৮ কিলোমিটার সড়ক ফুলে ফেঁপে উঠে। এটাকে প্রকৌশলীদের ভাষায় রাটিং বলে।
শুধু ওই সড়ক নয়, যশোরে সওজের অধীন মোট সড়ক রয়েছে ৩২১ কিলোমিটার। এরমধ্যে ৩০ কিলোমিটার সড়কে রয়েছে রাটিং।এবং অর্ধশত কিলোমিটার সড়ক ভাঙ্গা বা গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। যা যানবাহন চলাচলে ঝুঁকি তৈরি করছে।
অথচ সরকার গত ১০ বছরে এসব সড়কের নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণ করতে ব্যয় করেছে ২ হাজার কোটি টাকা। এতো টাকা ব্যয় করেও সড়কে সৃষ্টি হওয়া রাটিং ঠেকাতে পারছেনা। এতে ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করছে যানবাহনগুলো।
সড়কের যানবাহন চলাচলকারী অংশ, বিশেষ করে যে অংশের ওপর দিয়ে বেশির ভাগ যানবাহনের চাকা যায়, সেখানে চাকার আকৃতির সমান বা তার চেয়ে বেশি অংশ সমান্তরালে ডেবে যাওয়ার ঘটনাকে প্রকৌশলীদের ভাষায় বলা হয় রাটিং। সাধারণত সড়কে নিম্নমানের বিটুমিন ব্যবহার করা হলে কিংবা সড়ক নির্মাণের ধাপগুলোয় সঠিক নিয়মে নির্মাণ উপকরণ ব্যবহার না করলে এ ধরনের সমস্যা দেখা দেয়। আবার সড়কের ধারণক্ষমতার চেয়ে বেশি ওজন নিয়ে যানবাহন চললেও দেখা দিতে পারে রাটিং।
অন্যদিকে যোগাযোগ অবকাঠামো বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, ‘ওভারলোডের’ পাশাপাশি নির্মাণকাজের মান যথাযথ না হলেও এমনটি ঘটতে পারে।
যশোর খুলনা সড়কের পালবাড়ী থেকে নওয়াপাড়া পর্যন্ত বিভিন্ন স্থানে রয়েছে রাটিং। সরেজমিন পালবাড়ী থেকে মনিহার পর্যন্ত সড়কে গিয়ে দেখা যায়, সড়কে রয়েছে উঁচু-নিচু অবস্থা। এই সড়কে ভারি যানবাহন চলাচল করছে ঝুঁকি নিয়ে। ওই এলাকার মুদি দোকানি গোলাম রব্বানী বলেন, আমাদের এই সড়ক দিয়ে প্রতিদিন শত শত যানবাহন চলাচল করে। বড় গাড়ি গেলে দোল খায়। বিশেষ করে মোটরসাইকেল নিয়ে যারা যাতায়াত করেন, তাদেরকে বেশি ঝুঁকি নিয়ে পথ চলতে হচ্ছে।
সওজ সূত্রে জানা গেছে, তাদের অধীন ৩২১ কিলোমিটার সড়কের মধ্যে সবেচেয়ে বেশি রাটিং রয়েছে যশোর-খুলনা সড়কে ১৮ কিলোমিটার। এরমধ্যে চাঁচড়া-পালবাড়ী ও পালবাড়ী-মান্দার তলায় ১৪ কিলোমিটারের মধ্যে ১১ কিলোমিটার সড়কে রয়েছে রাটিং। এছাড়া আরবপুর, পালবাড়ী, বোর্ড অফিসের সামনে, রুপদিয়া, মুড়লী, বসুন্দিয়া, পদ্মবিলা এবং অভয়নগরের নওয়াপাড়া এলাকায় বেশি রাটিং সড়ক রয়েছে।
যশোর-খুলনা মহাসড়ক নির্মাণের মাত্র ৮ মাসের মাথায় সড়ক উঁচুনিচু হয়ে পড়ে। সওজ কর্তৃপক্ষ ৩৮ কিলোমিটারের মধ্যে ১৭ কিলোমিটার রাস্তার বেহার অবস্থা দেখে কংক্রিট রাস্তা করার জন্য সড়ক মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠায়। এরমধ্যে ৪ কিলোমিটার রাস্তা প্রথম পর্যায়ে কংক্রিট বা ঢালাই রাস্তা করার জন্য বলা হয়েছে। যাতে ব্যয় প্রস্তাব করা হয়েছে ৫০ কোটি টাকা। বর্তমানে সড়কটি কংক্রিটের করার কাজ চলমান। এই সড়কে আরও ৫০ কোটি টাকার চেয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে।
যশোর-খুলনা মহাসড়কের উন্নয়নের কাজ শুরু করা হয় ২০১৮ সালের মে মাসে। ২০২২ সালের জুনে সড়কের কাজ শেষ করা হয়েছিল। সড়কের নির্মাণকাজ চলমান থাকাবস্থায় ৮ কিলোমিটার সড়ক ফুলে ফেঁপে উঠে। ওই সময় সরকার বুয়েটের একজন শিক্ষককে পরামর্শক নিয়োগ করেন। তিনি সরেজমিন ঘুরে সড়কের দু’পাশে ওয়ারিং করার সুপারিশ করেছিলেন।
সড়ক ও জনপথ বিভাগ যশোরের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী আরিফ মাহমুদ জানান, সড়কে আঁকা-বাকা হয়ে ফুলে ফেঁপে উঠছিল। আমাদের পরামর্শকের সুপারিশ অনুযায়ী সড়কের ১৮ কিলোমিটার রাস্তা কংক্রিট (ঢালাই) করার জন্য বলেছে। আমরা সেই অনুযায়ী মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠিয়েছি। ৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রথমে শহরের মুড়লী রেলক্রসিং থেকে নওয়াপাড়া-ভাঙ্গা পর্যন্ত ৬টি রেলক্রসিংয়ে ৪ কিলোমিটার ঢালাই রাস্তা করা হচ্ছে। পর্যায়ক্রমে ১৮ কিলোমিটার সড়কে ঢালাই করা হবে।
সওজ সূত্র জানায়, যশোর-খুলনা মহাসড়কের ৩৮ কিলোমিটার উন্নয়নে ৩শ’২১ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয় সরকার। মহাসড়কটি যশোর শহরতলীর পালবাড়ি মোড় থেকে শুরু হয়ে অভয়নগর উপজেলার নওয়াপাড়ার রাজঘাট পর্যন্ত নতুন করে নির্মিত হয়। ২৭ কিলোমিটার কাজ সম্পন্ন করেছেন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মাহবুব এন্ড ব্রাদার্স, তমা কনস্ট্রাশন এন্ড কোং। অথচ ৮ কিলোমিটার সড়কে সৃষ্টি হয়েছিল রাটিং। এছাড়া আরও ১০ কিলোমিটার সড়ক ফুলে-ফেঁপে উঠায় মোট ১৮ কিলোমিটার সড়কে সৃষ্টি হয়েছে রাটিং। যে কারণে সড়কটিতে যানবাহন চলাচলে ঝুঁকি সৃষ্টি করছে।
সড়কটি বর্তমানে ২৪ ফুট চওড়া রয়েছে। সড়ক দুটির কাজের শুরুতেই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ উঠেছিল। এলাকাবাসীর অভিযোগ, সড়ক উন্নয়নের এ কাজে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান দরপত্রের কোন নিয়মনীতি মানেনি। তারা গোজামিল দিয়ে ইচ্ছামত কাজ চালিয়ে গেছেন। ঠিকাদাররা সড়কের পুরনো বৃটিশ আমলের লোনা ধরা ইট ও খোয়া তুলে সেটাই আবার ভেঙ্গে গর্তে ব্যবহার করেছেন। যা দরপত্রে বলা হয়নি। এছাড়া, সড়কটি ৫ ফুট গর্ত করে ভিত তৈরির নির্দেশনা থাকলেও সেই নিয়মও মানেনি। সড়কে নতুন ইট বালি, খোয়া ব্যবহার না করে খুঁড়ে উঠানো মালামালই ফের ভরাট করা হয়েছে। যেকারণে সড়কটির শনির দশা কাটেনি।
যশোর বাস মালিক সমিতির সভাপতি বদরুজ্জামান বাবলু জানান, যশোর-খুলনা নতুন হওয়া সড়কে এমন ফুলেফেঁপে উঠা কখনও দেখিনি। বর্তমানে ঘষেমেজে আকা-বাকা ঠিক করা হয়েছে। সওজের সঙ্গে আতাত করে ঠিকাদরি প্রতিষ্ঠান সড়কের কাজে অনিয়ম করার কারণে এমনটি হয়েছে। এতে সড়কের স্থায়ীত্ব নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন। তিনি বলেন, সড়কে রাটিং থাকলে সব যানবাহনের জন্য সেটি ঝুঁকি। সরকার শত শত কোটি টাকা খরচ করলেও সড়কের মানে উন্নতি হচ্ছে না।
এ ব্যাপারে যশোর সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী গোলাম কিবরিয়া বলেন, গত ১০ বছরে আমরা সড়র উন্নয়নে প্রায় ২ হাজার কোটি টাকার কাজ করেছি। যেসব সড়কে রাটিং দেখা দিয়েছে সেখানে আমরা চলাচল উপযোগী করছি। যশোর-খুলনা সড়কে কাজ চলমান থাকাবস্থায় কিছু জায়গায় সমস্যা হয়েছিল। সেগুলো ঠিক করা হয়েছে। পরামর্শকের মতামত অনুযায়ী সেখানে ৪ কিলোমিটার ঢালাই রাস্তা করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, রাটিং তো বিভিন্ন কারণে হয়। একটা বড় কারণ হলো বিটুমিন। আগে সড়ক নির্মাণে আমরা ৬০-৭০ গ্রেডের বিটুমিন ব্যবহার করতাম। এখন আরো উন্নত বিটুমিন ব্যবহার করা হচ্ছে। আরেকটি কারণ হলো যানবাহনের ওভারলোড। আমাদের স্ট্যান্ডার্ড লোডিং প্যাটার্ন হলো, ছয় চাকার দুই এক্সেলের গাড়িগুলোয় সাড়ে ১৫ টন পর্যন্ত ভার বহন করা যাবে। আর ১০ চাকার তিন এক্সেলের জন্য সর্বোচ্চ ওজনসীমা ২৩ টন। কিন্তু আমাদের মন্ত্রণালয় (সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়) দুই এক্সেলের যানবাহনে সর্বোচ্চ ২২ টন, আর তিন এক্সেলের যানবাহনের জন্য সর্বোচ্চ সাড়ে ২৭ টন ওজন বহনের অনুমতি দিয়েছে। এতেও সড়কের উপর চাপ সৃষ্টি করছে।